ঢাকা | জুন ১৭, ২০২৫ - ২:৩৫ অপরাহ্ন

শিরোনাম

অর্থ পাচার বসুন্ধরা চেয়ারম্যানের দুই ছেলের সম্পত্তির তথ্য জানিয়ে যুক্তরাজ্যে দুদকের চিঠি

  • আপডেট: Tuesday, June 17, 2025 - 12:28 am

সোনালী ডেস্ক: বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের দুই ছেলে-গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সাফিয়াত সোবহান (সানভীর) এবং ভাইস চেয়ারম্যান সাফওয়ান সোবহানের ‘যুক্তরাজ্যে পাচার করা সম্পদের’ তথ্য জানিয়ে সে দেশে চিঠি পাঠানোর কথা বলেছেন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন।

গতকাল সোমবার রাজধানীতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, “আজ আমরা আরও কয়েকটি সম্পত্তির তথ্য যুক্তরাজ্যে পাঠিয়েছি। এর মধ্যে রয়েছে আকবর সোবহান সাহেবের দুই ছেলে, সাফিয়াত ও সাফওয়ানের কিছু সম্পত্তির তথ্য।”

চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এবং তার স্ত্রী-সন্তানদের বিরুদ্ধে ‘সরকারের রাজস্ব ফাঁকি, ভূমি জবরদখল, ঋণের অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ স্থানান্তর ও হস্তান্তরসহ মানি লন্ডারিংয়ের’ অভিযোগের অনুসন্ধান করছে দুদক। এর অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের দুদকে তলবও করা হয়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদের ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি এবং এনআরবিসি কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমামের মালিকানাধীন কিছু সম্পত্তি নিয়েও লন্ডনে তথ্য পাঠানো হয়েছে বলে জানান দুদক চেয়ারম্যান।

তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি, এসব প্রচেষ্টার সুফল আমরা অচিরেই পাব।” দুদকের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি সাবেক লন্ডনে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের সম্পদ জব্দের কথা জানায় যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ)। এর আগে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান এফ রহমান এবং তার চাচাতো ভাই আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের যুক্তরাজ্যে থাকা সম্পত্তি জব্দ করেছিল এনসিএ। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর চেষ্টায় গতি আনতে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে লন্ডন সফর করেন দুদক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।

সোমবারের ব্রিফিংয়ে তিনি সেই সফরের অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, আমরা আমাদের কর্মসূচিতে লন্ডন গিয়েছি। সেই সময় মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাও সেখানে সফরে ছিলেন, কাজেই আমাদের যাওয়াটা একসাথে হয়েছে। কিন্তু প্রোগ্রামটা ছিল ভিন্ন। আমাদের আগে থেকে ঠিক করা ছিল। আমরা আগে থেকেই ঠিক করেছিলাম যে, লন্ডনে তাদের জাতীয় অপরাধ সংস্থা (ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি-এনসিএ) এবং আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দমন সংস্থা (ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি-করাপশন কোঅর্ডিনেশন সেন্টার) এর সঙ্গে বৈঠক হবে।

আমরা বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ও সম্পদের একটি প্রাথমিক তালিকা এবং আদালতের আদেশ সংযুক্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছি। এবার, আমি বলতে পারি, এনসিএ খুবই কার্যকরভাবে কাজ করেছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদের অনুপার্জিত আয় ও পাচারকৃত অর্থে কেনা অনেক সম্পদ তারা জব্দ করতে আমাদের সহায়তা করেছে। এনসিএর এই বন্ধুসুলভ সহযোগিতার জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছি।

মোমেন বলেন, আমাদের লন্ডনে উপস্থিত থাকার সময়ই এই সম্পদ জব্দের আদেশ জারি হয়। জাবেদ সাহেবের মোট ৫৮০টি বাড়ির খোঁজ আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে ৩৪৩টি যুক্তরাজ্যে, ২২৮টি সংযুক্ত আরব আমিরাতে এবং ৯টি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রপার্টি বাদ দিয়ে বলছি, শুধু যুক্তরাজ্যের ৩৪৩টি বাড়ির আনুমানিক মূল্য প্রায় ৭৩.১৫ মিলিয়ন পাউন্ড, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১০২৫ কোটি টাকা। এনসিএ ইতোমধ্যে এই সম্পদ ফ্রিজ করেছে।

এছাড়া তার প্রায় ২৫ লাখ ডলারের সমপরিমাণ ব্যাংক আমানত (প্রায় ৩৫ কোটি টাকা) ফ্রিজ করা হয়েছে। আরও কিছু দেশে তার সম্পত্তি আছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ একাধিক দেশে ‘মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স রিকোয়েস্ট’ পাঠানোর কথা তুলে ধরে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের সৌভাগ্য যে, যুক্তরাজ্য প্রথমে সাড়া দিয়েছে।

লন্ডন সফরের সময় ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি-করাপশন কোঅর্ডিনেশন সেন্টার অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে একটি ‘আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কাঠামো’ তৈরি করার চেষ্টা করার কথা জানান দুদক চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এই ধরনের অনুসন্ধান ও আইনি ব্যবস্থায় এখনও অভিজ্ঞ নয়, তাই এনসিএ আমাদের প্রশিক্ষণ দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইতোমধ্যে একজন বিদেশি প্রশিক্ষক আমাদের সঙ্গে কাজ শুরু করছেন।

“বাংলাদেশ ব্যাংকও এই উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে। গভর্নর নিজে লন্ডনে এসে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে পৃথক সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন।’ মোমেন বলেন, “এখানে একটা সূক্ষ্ম বিষয় রয়েছে-জব্দকৃত সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনতে হলে আমাদের দাবি যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের আদালতের আদেশের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের আদালতেরও সম্মতি লাগবে। সেটা ছাড়া সম্পদ ফেরত আসবে না।”

তিনি বলেন, ”জাবেদ সাহেবের বিষয়ে যেটি বললাম, তা ছাড়াও আমরা আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছি। তবে শেষ পর্যন্ত এই মামলা ও টাকা আদায়ের কাজটি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমেই সম্পন্ন হবে। আমরা বিএফআইইউ-র সঙ্গেও সমন্বয় করে কাজ করছি। আশা করি, বাকিদের ক্ষেত্রেও আমরা সফল হব।” যারা অর্থ পাচার করছে, তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে অর্থ ফেরত আনার একটি প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা হয়েছে-সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “দুদকের পক্ষ থেকে আমরা শুধু বলতে চাই, দুদকের যেসব মামলা রয়েছে, তার কোনোটিই কম্পাউন্ডেবল নয়। আমাদের মামলাগুলোর ক্ষেত্রে কোনো আপস বা সমঝোতার সুযোগ নেই।

”যেহেতু দুদকের মামলা ফৌজদারি প্রকৃতির, সেগুলোর নিষ্পত্তি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব নয়। তবে গভর্নর যে দেওয়ানি মামলার কথা বলেছেন, তা আমাদের আওতাভুক্ত নয়। আমরা দুদকের বিধিবদ্ধ আইনের আওতায় থেকে যতটুকু করণীয়, তা করে যাচ্ছি।” পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে সাফল্য খুব সীমিত; এক-দুটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে কার্যত নজির নেই। এ পর্যন্ত যেটুকু অর্থ ফেরত এসেছে, তার জন্য যে পরিমাণ ব্যয় হয়েছে, সেটিও কম নয়।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “যখন একটি দেশের টাকা অন্য দেশে চলে যায়, তখন সেই দেশ স্বাভাবিকভাবেই বলবে, ‘এটা আমার টেরিটোরির সম্পদ। আমি কেন ফেরত দেব?’ আমরা যদি আইনগতভাবে প্রমাণ করতে পারি যে ওই অর্থ অবৈধভাবে পাচার হয়েছে, তবেই তা ফেরত পাওয়া সম্ভব। তবে এটা সহজ কাজ নয়। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে সব অর্থ ফেরত আনা সম্ভব।

তবে যতটুকু আমরা আইনের আওতায় প্রমাণ করতে পারব, ততটুকু ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।” আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা আগের সরকারের সময়ও অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন যারা ক্ষমতায় আছে তাদের বিরুদ্ধেও যদি স্পেসিফিক অভিযোগ আসে, আমরা অবশ্যই অনুসন্ধান তদন্ত করব।

কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কেউ অভিযুক্ত হবেন না। আমরা প্রমাণভিত্তিক কাজ করি। “অর্থ পাচার প্রমাণের ক্ষেত্রে আমাদের আদালতের রায় বিদেশে পাঠালেই যথেষ্ট নয়। সেই দেশের কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে কীভাবে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে, কোন ব্যাংকে গিয়েছে বা সম্পদে রূপান্তর হয়েছে। প্রমাণ ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়।” কিছু সম্পদ কেম্যান আইল্যান্ডেও চলে গেছে জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “সেগুলো আমরা এখনও অনুসরণ করতে পারিনি।

”আওয়ামী লীগের অনেকে এখন ভারতেও অনেকে অবস্থান করছেন, তাদের ব্যয় বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ দিয়েই চলছে বলে অনেকের ধারণা-এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ”ভারতের সঙ্গে ২০১১ সালের চুক্তি রয়েছে, যা কাজে লাগিয়ে অপরাধীদের ফেরত আনা সম্ভব হতে পারে।”

আওয়ামী লীগ সরকারের তিনজন মন্ত্রী লন্ডনে অবস্থান করছেন। তাদের বিদেশি নাগরিকত্ব থাকার অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করলে মোমেন বলেন, “আমরা দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে সরকারি পর্যায়ে তদন্ত করছি। কারণ এটি অনেক সময় মানি লন্ডারিংয়ে সহায়ক হয়।” অর্থ পাচার বিষয়ে চারটি সংস্থা কাজ করছে, কোনো সমন্বয়হীনতা রয়েছে কিনা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত দুদকের দৃষ্টিকোণ থেকে সমন্বয়হীনতা স্পষ্টভাবে দেখা যায়নি।

তবে যেহেতু অন্য সংস্থাগুলোর কাজও জড়িত, তাই সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে।” দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা লক্ষ্য করছি, অনেকেই বিদেশ থেকে তাদের বাংলাদেশের সম্পত্তি বিক্রি করতে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিচ্ছেন। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। “অভিযোগ যাচাই প্রক্রিয়ায় যদি রাজনৈতিক ট্যাগিং বা পক্ষপাত দেখা যায়, সেটি খতিয়ে দেখা হবে।

দুদককে শক্তিশালী করতে আমরা সবার সহযোগিতা চাই। যারা তথ্য দেন, তারা আমাদের অংশীদার। আপনারা যদি শেখ হাসিনা বা তার পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দেন, সেটিও কাগজপত্রসহ হলে আমরা বিবেচনা করব। তবে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সবকিছু একসাথে করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা থেমে থাকি না। আমরা এগিয়ে যাব।”

Hi-performance fast WordPress hosting by FireVPS