ঢাকা | মার্চ ৩, ২০২৫ - ৯:২০ অপরাহ্ন

জিআই সনদেও থামছে না ভেজাল কাঁচাগোল্লা বিক্রি

  • আপডেট: Sunday, March 2, 2025 - 11:04 pm

প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা

বুলবুল আহমেদ, নাটোর থেকে: নাটোরের সেই বিখ্যাত মিষ্টান্ন কাঁচাগোল্লা নিজস্ব পণ্য হিসেবে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এইতো ক’দিন আগে। কাঁচা ছানা থেকে তৈরি মিষ্টান্ন কাঁচাগোল্লা গোলাকার আকৃতির নয়।

কিন্তু চিনি মেশানো কাঁচা ছানা ছোট ছোট বলের মতো তৈরির পর ‘নাটোরের কাঁচাগোল্লা’ নামে বিক্রি ঠেকাতে ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে মিলেছে এই স্বীকৃতি। দেশের ১৭তম পণ্য হিসেবে জিআই স্বীকৃতি পায় নাটোরের কাঁচাগোল্লা।

গত ৮ আগস্টে (২০২৩) পেটেন্ট, শিল্প নকশা ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানের সাক্ষরিত সনদে নাটোরের কাঁচাগোল্লাকে জিআই স্বীকৃতির অনুমোদন দেয়া হয়।

এরপর থেকে রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ডসহ সবখানেই নাটোরের নামে বিক্রি হওয়া ‘ভেজাল কাঁচাগোল্লা’র বিক্রি বন্ধ হবে, এমনটি মনে করেছিলেন নাটোরের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

কিন্তু বাস্তবে চিত্র ভিন্ন জিআই পণ্যর স্বীকৃতির পরেও ঐসব জায়গায় ভেজাল কাঁচাগোল্লা বিক্রির দৌরাত্ম্য থামছে না। ফলে নাটোরের প্রকৃত কাঁচাগোল্লা সম্পর্কে ভিন্ন জায়গার ভোক্তাদের বিরূপ ধারণা তৈরি হবে। এমনটি মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিনে নাটোর রেলস্টেশন এলাকাতে গেলে দেখা যায়, ছোট ছোট পেকেট নিয়ে বগিতে বগিতে কাঁচাগোল্লা বিক্রি করছেন ফেরিওয়ালারা। সেখানে প্রতি কেজি কাঁচাগোল্লা বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকা দরে।

ট্রেনের যাত্রীদের ও দরকষাকষি করে নিতে দেখা যায় এসব কাঁচাগোল্লা। সদর উপজেলার আগদীঘা এলাকার রনি ইসলাম। তিনি দ্রুতযান এক্সপ্রেসে নাটোর থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন। নাটোর স্টেশনে ট্রেন আসলে নিজ আসনে বসতেই বগিতে কাঁচাগোল্লা বিক্রি হচ্ছে দেখে দাম জিজ্ঞেস করে রনি।

৩৫০ টাকা কেজি দাম শুনে কিছুটা অবাক হলেন তিনি। পরে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে একটি পেকেট নিয়ে খুলতেই আসল কাঁচাগোল্লা’র সাথে এর পার্থক্য বুঝতে পারলেন। এবং অন্যদের বিষয়টি অবগত করলেন।

রনি বলেন, আমি নাটোরে স্থানীয় হওয়াতে এবং আসল কাঁচাগোল্লা চেনায় ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কাঁচাগোল্লা ক্রয় করিনি। কিন্তু ট্রেনে থাকা অনেক মানুষ যারা আসল কাঁচাগোল্লা কোনটি জানেনা।

তাঁরা এসব কাঁচাগোল্লা কিনছেন, কিন্তু তারা এর সঠিক স্বাদ পাবে না। ফলে তাদের কাঁচাগোল্লার স্বাদ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরি হবে এবং পরবর্তী সময়ে কিনে খাবে না। ফলে কাঁচাগোল্লার সুনাম এবং বাজার দুটোই নষ্ট হবে। তাই ভেজাল কাঁচাগোল্লা বিক্রি বন্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন রনি।

একই চিত্র নাটোর বাসস্ট্যান্ড এলাকাতেও। সেখানে গেলে দেখা যায়, হাতে ব্যাগ ভর্তি কাঁচাগোল্লা নিয়ে বিক্রি করছেন এক ব্যক্তি। প্রতিবেদক দরদাম করলে ৪০০ টাকা কেজিতে কাঁচাগোল্লা দিতে রাজি হন ঐ বিক্রেতা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ ব্যক্তি জানান তার মতো আরও ৫ থেকে ৭ জন এভাবে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ফেরি করে কাঁচাগোল্লা বিক্রি করে। তারা নাটোর থেকে আশে-পাশের জেলাগুলোতে চলাচলকারী বিভিন্ন বাসের যাত্রীদের কাছে এগুলো বিক্রি করেন বলে জানান।

এবার যাওয়া যাক নাটোরের প্রসিদ্ব কাঁচাগোল্লা তৈরির কারখানায়। শহরের লালবাজার এলাকায় জয়কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। সেখানকার স্বত্ত্বাধিকারী প্রভাত কুমার পালের সাথে আমরা কথা বলি, তিনি জানিয়েছেন এক কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরিতে তাদের খরচ পরে ৪৫০- ৪৮০ টাকা।

সেই জায়গায় ৩ থেকে ৪’শ টাকায় কাঁচাগোল্লা বিক্রি হচ্ছে শুনে বেশ বিব্রত হন তিনি। তিনি বলেন, বাপ- দাদা’রা সেই সময় থেকে কাঁচাগোল্লা তৈরি করে আসছে। তাদের এ কর্ম ধরে রাখতে আজও আমরা কাঁচাগোল্লা তৈরি করছি। সারা দেশে কাঁচাগোল্লার সুনাম ও খ্যতি রয়েছে আমাদের দোকানের।

তিনি জোর দিয়ে বলেন ঐ দামে বিক্রি করা ঐসব আসল কাঁচাগোল্লা হতে পারে না। ফলে কাঁচাগোল্লার সুনাম ও খ্যাতি ধরে রাখতে এখনি ভ্রাম্যমাণভাবে কাঁচাগোল্লা বিক্রি বন্ধে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানান তিনি।

কাঁচাগোল্লাকে জিআই পণ্যর স্বীকৃতিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশের পাশাপাশি ভেজাল কাঁচাগোল্লা বিক্রি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন নাটোরের গণমাধ্যম কর্মী গোলাম রাব্বানী ।

তিনি বলেন, কাঁচাগোল্লার এই স্বীকৃতি নাটোর বাসীকে সম্মানিত করেছে। তাই এখন আমাদের প্রয়োজন এই সম্মান ধরে রাখা। সেই সম্মান ধরে রাখতে হলে কাঁচাগোল্লার বিকৃতি ও ভেজাল তৈরি বন্ধে প্রশাসনের পাশাপাশি সচেতন নাটোর বাসীকে সজাগ থাকতে হবে। তবে শুধু ভ্রাম্যমাণ ভাবেই যে নকল কাঁচাগোল্লা বিক্রি হয় বিষয়টি তেমন নয়।

ঐতিহ্যবাহী এই কাঁচাগোল্লা দীর্ঘদিন ধরে বিকৃত আকারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়ে আসছে। গত বছর (২০২৩) ফেব্রুয়ারিতে দেশের নামকরা একটি খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নাটোরে তাদের ব্রান্ড শপে গোলাকার কাঁচাগোল্লা বিক্রি শুরুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। মূলত এরপরেই নাটোরের সুধীমহল এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করে।

পরে ঐতিহ্যবাহী নাটোরের এই কাঁচাগোল্লাকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) নিবন্ধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন নাটোরের সাবেক জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ।

গত ৩০ শে মার্চ (২০২৩) শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) বরাবর নাটোরের কাঁচাগোল্লাকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন পাঠায় জেলা প্রশাসন।

যার ফলশ্রুতিতে গত ৮ আগস্ট (২০২৩) জিআই পণ্যর স্বীকৃতি পায় নাটোরের কাঁচাগোল্লা। ট্রেন, বাস সহ বিভিন্ন জায়গায় ভেজাল কাঁচাগোল্লা বিক্রি বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে নাটোরে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জানান, কাঁচাগোল্লা ভেজাল বন্ধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিভিন্ন সময় জেলার পর্যটন পূর্ণ জায়গা গুলোতে অভিযান পরিচালনা করেছে। এখন যেহেতু কাঁচাগোল্লাকে জিআই পন্যর স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

সেহেতু এগুলো বন্ধের আরও জোরদার অভিযান চালানোর কথা জানান এই কর্মকর্তা। তিনি আরও জানান, ফেরিওয়ালাদের জন্য কিছুটা আইনি ছাড় থাকলেও কাঁচাগোল্লার ক্ষেত্রে এখন থেকে আর ছাড় দেয়া হবে না।