ঢাকা | নভেম্বর ২৫, ২০২৪ - ১১:৫১ পূর্বাহ্ন

শহিদ জামিল দিবস: যা ঘটেছিল সেদিন!

  • আপডেট: Thursday, May 30, 2024 - 9:00 pm

জগদীশ রবিদাস: ৩১ মে শহিদ ডা. জামিল আক্তার রতনের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৮ সালের এই দিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রমৈত্রীর তৎকালীন নেতা জামিল আক্তার রতনকে প্রায় ৩৫ জন শিক্ষকদের সামনে হুইসেল বাজিয়ে হামলা চালিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসীরা।

১৯৮৮ সালের ৩১ মে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখার ছাত্রমৈত্রীর নেতা জামিল আক্তার রতনকে প্রকাশ্যে রগ কেটে হত্যার পর শিবির সেখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় একক নিয়ন্ত্রণ নেয়। শুরু হয় বর্বরোচিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এতে সর্বস্তরে নিন্দিত হয় এই ছাত্র সংগঠনটির “রগ কাটার” রাজনীতি।

নব্বইয়ের দশকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হয়ে উঠেছিলো সে সময়ের প্রগতিশীলতার প্রতীক। ছোটখাটো গড়নের এক দুর্দান্ত মেধাবী ছাত্রনেতা জামিল আকতার ছিলেন যার মধ্যমণি।

আজন্মবিপ্লবী জামিলের চোখে মুখে ছিলো এক গভীর স্বপ্ন, শ্রেণীহীন, শোষণহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হতো রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রগতিশীল আন্দোলন।

ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৯৮৮ সালের ৩০ মে রাতে। ছাত্র শিবির মিছিল করছে। এমন সময় অন্ধকার থেকে কে বা কারা আওয়াজ তোলে “ধর-ধর”। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে কোনো সংগঠন মিছিল করলে কেউ “ধর-ধর” করবে এমন সংস্কৃতি কখনোই ছিলো না।

একটা মেডিকেল কলেজে সব মিলিয়ে কয়েক শ’ ছাত্র থাকে। রাজনৈতিক রেষারেষি হয়তো থাকে, কিন্তু সেটা খুন পর্যন্ত গড়ানো সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে একটু অস্বাভাবিক ছিলো। সে সময় রাজশাহী মেডিকেলে শিবির সমর্থন করতো সব মিলিয়ে বড়জোর ৩০-৪০ জন ছাত্র। এই ধর-ধর শব্দের পরেই শিবিরের সেই মিছিলে এসে জুটল শতাধিক লোক, সবার হাতেই অস্ত্র। সেই অস্ত্র নিয়ে তারা সারারাত চালালো মধ্যযুগীয় মহড়া।

সকাল হতেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিছিল নিয়ে অধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিলো এবং অভিযোগ করলো। মেইন হোস্টেলের কোলাপসিবল গেট বন্ধ করে অস্ত্রসহ শিবিরের অনেক বহিরাগত অবস্থান করছে।

ততক্ষণে একাডেমিক কাউন্সিল এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে করণীয় কি, তার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নিয়ে মিটিংয়ে বসে গেছেন।

ছাত্রদের অভিযোগ শুনে একাডেমিক কাউন্সিল সরেজমিনে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই মিটিং থেকেই অধ্যক্ষসহ প্রায় তিরিশ জন শিক্ষকের একটি দল মেইন হোস্টেলে যান। কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে জামিল আকতার রতন সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

শিক্ষকরা যখন মেইন হোস্টেলে ঢুকতে যান, তখনই বাধা আসে সেখানে অবস্থানরত শিবিরের ক্যাডারদের কাছে থেকে। এর মধ্য থেকে কয়েকজন বহিরাগত শিক্ষকদের সাথে উদ্ধতভাবে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। জামিল সেই বহিরাগতদের দেখিয়ে বলেন, “এই দেখুন স্যার, বাইরের লোক।”

এর মধ্যেই হঠাৎ এক অপার্থিব তীব্র হুইসেলের শব্দ আর “নারায়ে তাকবীর” বলে শিবিরের শতাধিক অস্ত্রধারী গুণ্ডা শিক্ষকদের সামনেই হত্যা করে জামিল আকতার রতনকে।

একাডেমিক কাউন্সিলের বিবৃতি থেকে জানা যায় ‘প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে গত ৩১ শে মে বেলা আনুমানিক ১১টায় কলেজের সাধারণ ছাত্ররা মিছিল সহকারে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এসে অভিযোগ করে, ইসলামী ছাত্র শিবিরের ছত্রছায়ায় একদল বহিরাগত অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রধান ছাত্রাবাসের পশ্চিম উত্তর ব্লকে অবস্থান করছে এবং কলেজে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তখন একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাউন্সিলের সদস্য ও অন্যান্য শিক্ষক অবস্থা দেখার জন্য ছাত্রাবাসে যান।

ছাত্রাবাসের দুটি ব্লক দেখে পশ্চিম-উত্তর ব্লকে যাবার সময় কিছু ছাত্র তাদের বাধা দেয়। এদেরকে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সদস্য ও সমর্থক বলে চিহ্নিত করা হয়। যারা বাধা দেয় তারা দাবি করে যে, তাদের প্রত্যেকের ৫জন করে অতিথি আছে এবং কোনমতেই ওই ব্লক পরিদর্শন করা যাবে না।

এর পরেও সেদিকে যাবার সময় তারা বাঁশি বাজিয়ে ‘নারায়ে তকবির’ শ্লোগানসহ মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে এসে নিচে দণ্ডায়মান সাধারণ ছাত্রদের ধাওয়া করে।

ওই অবস্থায় জামিল আখতার রতন নামে ৫ম বর্ষের একজন ছাত্রকে মারাত্মকভাবে আহত করে। তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার পর সে মারা যায় । উল্লেখ্য, ছাত্রাবাস থেকে আসার সময় ওই উচ্ছৃঙ্খল হাঙ্গামাকারিরা আবার বাধা দেয়। এ সময় গাড়ি ভাংচুর এবং বোমা নিক্ষেপ করা হয়।

বর্ণনা শুনে এটা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এই হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত পরিকল্পিত। স্বৈরাচার বিরোধী অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতির সবচেয়ে ক্ষুরধার নেতৃত্বকে সরিয়ে হত্যা আর দখলের রাজনীতি শুরুর টেস্ট কেস। এর সূত্র ধরেই শিবিরের দখলের তাণ্ডব শুরু হয় দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ থাকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, পর্যায়ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা দেশে।

স্বৈরাচারী শাসনকালের শেষ দিকে যেন শিবিরকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিরুদ্ধে, তাই স্বৈরাচার আর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লড়াই হয়ে উঠেছিল সমার্থক।

এদিকে, ৩১ মে শুক্রবার শহিদ জামিল আক্তার রতনের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ছাত্রমৈত্রীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।  জামিল দিবস উপলক্ষে শুক্রবার সকাল ১০টায়  রাজশাহী মেডিকেল কলেজে থাকা শহিদ জামিলের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।

সংবাদে প্রকাশিত তথ্য বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল ও তৎকালীন নেতৃবৃন্দ সূত্রে নেয়া।

সোনালী/জেআর