যেসব কারণে হঠাৎ ডিজেবল হয়ে যেতে পারে ফেসবুক পেজ-আইডি
অনলাইন ডেস্ক: দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ঘিরে অনলাইন ব্যবসা বেশ প্রসারিত হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নানা কন্টেন্ট বানিয়ে বিপুল অর্থ আয় করছে। কিন্তু সম্প্রতি অনেকের অভিযোগ, হঠাৎ করে তাদের ফেসবুক পেজ বা আইডি ডিজেবল বা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
গত তিন বছর ধরে রাজধানী ঢাকার ফাবিহা হাসান মনিষা নামে একজন তরুণী ‘ফুড আপ্পি’ নামক একটি ফেসবুক পেজ চালু করেন। তিনি তার ফেসবুক পেজে বিভিন্ন ধরনের কন্টেন্ট তৈরি করে সেগুলো আপলোড করেন তার ফেসবুকে। এর মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেন। তিন বছরের মধ্যে তার পেজে ফলোয়ার দাড়ায় ১.৫ মিলিয়ন বা পনেরো লাখ। কিন্তু হঠাৎ করে গত ২৪ এপ্রিল তার এই পেজটি উধাও হয়ে যায় ফেসবুক থেকে। নানা চেষ্টা করেও তিনি এখনো পর্যন্ত তার ফেসবুক পেজটি আর খুঁজে পাননি।
পরে একই নামে গত বৃহস্পতিবার নতুন একটি ফেসবুক পেজ চালু করে মিজ মনিষা লাইভে এসে জানান, ফেসবুকে কিছু ব্যক্তি তাদের পেজে ফেইক কপিরাইট স্ট্রাইক দিয়েছিলেন। যে কারণে কর্তৃপক্ষ ফেসবুক থেকে তাদের পেজটা ডিজেবল করে দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এমন অনেক ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ও পেজ ডিজেবল হয়ে গেছে। যারা শত চেষ্টা করেও তাদের অ্যাকাউন্ট ফেরত আনতে পারছেন না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ও আইটি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আশিকুর রহমান বলেন, ‘ফেসবুক একটি ফ্রি জিনিস। এটা যদি একটা পেইড অ্যাপস হতো, তাহলে হয়তো কর্তৃপক্ষ চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করে ব্লক করার আগে নোটিফাই করতো। এ কারণেই কোনো আইডি বা পেজ ব্লক হওয়ার পর ইমিডিয়েট সুরক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না।’
চলতি মাসে ট্রান্স জেন্ডার নিয়ে একটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা ফারহান আহমেদ জোভান ও সামিরা খান মাহি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই নাটকটি নিয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়। এরপরই এই দুই অভিনেতা-অভিনেত্রীর ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট হঠাৎ ‘ডিজেবল’ হয়ে যায়। যদিও পরে তারা আবার ফেরত পান তাদের নিজ নামের ফেসবুক পেজ দুটি।
সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছরে ফেসবুক সাপোর্ট সিস্টেমে মানুষের পরিবর্তে রোবটের ব্যবহার কারণে তাদের সাপোর্ট সিস্টেম বেশ ব্যহত হচ্ছে। যে কারণে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই হঠাৎ করে ফেসবকু অ্যাকাউন্ট বা পেজ ডিজেবল হয়ে যাচ্ছে।
ডিজেবল হয় কেন?
ফেসবুক ব্যবহারকারীদের জন্য মেটার স্পষ্ট বেশ কিছু নির্দেশনা রয়েছে। যেটিকে বলা হয় কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড গাইডলাইন।
সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য ফেসবুকের কমিউনিটি গাইডলাইন ছয়টি ভাগে বিভক্ত। এক- সহিংসতা ও অপরাধমূলক কার্যকলাপ, দুই- নিরাপত্তা, তিন- আপত্তিজনক কনটেন্ট, চার- সত্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা, পাঁচ- মেধাস্বত্ব (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি), ছয়. অনুরোধ ও সমাধান।, কমিউনিটি স্টান্ডার্ডের মধ্যে ফেসবুক বা মেটা কর্তৃপক্ষ সহিংসতা, অপরাধ ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।
গাইডলাইনে বলা আছে, ফেসবুকে কোনো প্রকার টেরোরিজম বা জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম চালানো যাবে না। অর্থাৎ আর্ন্তজাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন সম্পর্কে কোনো পোস্ট করলে বা ছবি আপলোড করলে তা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড ভায়োলেশন হিসেবে ধরা হবে এবং রিপোর্ট করা মাত্রই আপলোড করা কন্টেন্টসহ পুরো ফেসবুক পেজ বা গ্রুপ রিমুভ হয়ে যাবে।
এ ছাড়া আপত্তিজনক কনটেন্ট, হিংসাত্মক বক্তব্য, জাতি অথবা মানুষের ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ কিংবা শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে সরাসরি আক্রমণ করলেও তা নিয়ে রিপোর্ট হলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়। এক্ষেত্রে কখনো কখনো কয়েকদিনের জন্য পোস্ট বা কমেন্টস করা থেকে বিরত রাখা হয় অনেককে।
এছাড়াও ধর্ষণ, মৃতদেহ ও দুর্ঘটনাসহ নিম্নে উল্লেখিত বিষয়াবলীর ছবি অথবা ভিডিও পোস্ট করলে, দুর্ঘটনা আগুন কিংবা রক্তপাতের ছবি দৃশ্য প্রচার করলে, শ্মশানে মৃতদেহ পোড়ানো, যেকোনো ধরনের নির্যাতন- শিশু যৌন নির্যাতন, নারী যৌন নির্যাতন, অপ্রাপ্ত বয়স্ক নির্যাতন, প্রাণী শিকার, প্রাণী হত্যা, প্রাণী জবাই, প্রাণীর ক্ষত বা কাটা দৃশ্যমান ছবি বা ভিডিও প্রচার করলেও দ্রুত ব্যবস্থা নেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।
বুয়েটের অধ্যাপক আশিকুর রহমান বলেন, ফেসবুক তাদের নিয়ম নীতির বিষয়ে বেশ সতর্ক। এসব নীতিমালা ফলো করা না হলে কিংবা এসব বিষয়ে রিপোর্ট হলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ব্যক্তিগত আইডি, পেজ বা গ্রুপ ডিজেবল করে দেয়।
ডিজেবল হলে কী করবেন?
সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেসবুকে ভিডিও কন্টেন্টের ক্ষেত্রে রাইটস ম্যানেজার নামে একটি টুলস রয়েছে। যখন কোনো কন্টেন্ট ক্রিয়েটর নিজের একটি কন্টেন্ট তৈরি করে তার পেজে আপলোড করেন, তখন সেই ভিডিওটি অন্য কেউ চাইলে ডাউনলোড করে রাখতে পারে।
শুরুর দিকে অনেক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর রাইটস ম্যানেজার ব্যবহারের অনুমতি পান না। ফলে তারা কন্টেন্ট তৈরি করলেও সেখানে তাদের মালিকানা স্বত্ব বা কপিরাইট পুরোপুরি নিশ্চিত হয় না। ফলে নতুন ক্রিয়েটরদের অনেক ভিডিও ডাউনলোড করে অন্য (পুরাতন) ক্রিয়েটররা তাদের রাইটস ম্যানেজারে সেগুলো আপলোড করেন। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি হলেও আসলে যিনি ওই কন্টেন্টটি তৈরি করেছেন, তার পক্ষে মালিকানা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেসবুকের দুর্বলতার কারণে রাইটস ম্যানেজার ব্যবহার করে একজনের ভিডিওর স্বীকৃতি আরেকজন নিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবস্থাপনার কারণে ফেসবুক উল্টো মূল ক্রিয়েটরের পেইজ ডিজেবল করে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে মুক্তি ডিজেবল অ্যাকাউন্ট বা পেজ ফিরে পেতে কতদিন সময় লাগতে পারে বা প্রক্রিয়া কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কখনো কখনো ছয় মাস থেকে এক বছরেরও বেশি সময় লাগে। আবার কখনো কখনো একেবারে ফেরত নাও আসতে পারে যদি সেটি সঠিকভাবে নিবন্ধন করা না থাকে। ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট বা পেজের ক্ষেত্রে এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়মে আবেদন করার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ- নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্ট/পেজে ব্যবহৃত ইমেইল এড্রেস বা ফোন নম্বর ব্যবহার করুন। অবশ্যই এই ইমেইল অ্যাকাউন্ট বা ফোন নম্বরে অ্যাক্সেস থাকতে হবে। যে মাধ্যমে এর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করতে পারে।
এ ছাড়া ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ও পেজ খোলার ক্ষেত্রে আসল নাম ব্যবহার করার পরামর্শ তাদের। কেননা এটি ফিরে পেতে হলে ড্রাইভিং লাইসেন্স, জন্ম নিবন্ধন কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র দরকার হয়। সেগুলোতে কোনো ব্যক্তির পুরো নাম থাকে। সুতারং আইডি কার্ডের নামে অ্যাকাউন্ট না থাকলে অনেক সময় ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ফেরত পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে যেতে পারে।
ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট বা পেজ কি নিরাপদ?
ফেসবুকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড অমান্য করলে ফেসবুক স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনেকে আইডি লিমিট (রেস্ট্রিকটেড) করে দেয়। কখনো সাত দিন বা এক মাসের জন্য পোস্ট করা বন্ধ, কখনো কমেন্ট ও শেয়ার করা বন্ধ হয়।
তবে এই সমস্যাগুলো একটি নির্দিষ্ট সময় পর ঠিক হয়ে যায়। এর মধ্যে যদি কারো আইডি ভুয়া মনে হয় তাহলে তার আইডি নিষ্ক্রিয় (ইনঅ্যাক্টিভ) করে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে গত কয়েক বছর ধরে সারা বিশ্বে বিশেষ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ফেসবুক ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট বা পেজ সিস্টেম চালু করেছে।
যেখানে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে আবেদন করলে অনেক অ্যাকাউন্ট ও পেজ ভেরিফায়েড করে থাকে মেটা বা ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যাচ্ছে, নীতিমালা ভঙ্গ বা অন্য কোনো কারণে ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ কিংবা অ্যাকাউন্টও ডিজেবল হয়ে যাচ্ছে।
এটিকেও মেটা কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অনেক অসাধু কন্টেন্ট ক্রিয়েটর নিজেদের স্বার্থে ফেসবুকের নীতিমালার অপব্যবহার করে বিভিন্ন আইডি কিংবা পেজে রিপোর্ট করছে। যার ফলে ফেসবুকের রোবটিক সিস্টেমে কোনো কোনো অ্যাকাউন্ট বা পেজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
এই বিষয়গুলোকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা হিসেবে দেখছেন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের কেউ কেউ।
তবে বুয়েটের অধ্যাপক আশিকুর রহমান বলছেন, ‘রুলস ও কমিউনিটি স্টান্ডার্ড পুরোপুরি মেনে বাংলাদেশের অনেকে ফেসবুক ব্যবহার না করার কারণে অনেক ব্যবহারকারী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবে ফেসবুকের গাইডলাইনের বাইরে ব্যবহারকারীদের নিজে থেকেও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’
সোনালী/ সা