৬৩২ পুলিশের তালিকা করে বিদেশে নালিশ বিএনপির
অনলাইন ডেস্ক: বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গুম-খুন এবং নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত– এমন অভিযোগ এনে পুলিশের ৬৩২ জনের তালিকা তৈরি করেছে বিএনপি। বিদেশি দূতাবাস ও মানবাধিকার সংস্থায় এদের বিরুদ্ধে নালিশ করছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বলেন, এসব অন্যায়-অপকর্মের জন্য তাঁদের শাস্তি হওয়া দরকার।
তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী মানুষের মৌলিক মানবাধিকার হরণকারীদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেওয়া কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী সরকারকে সহযোগিতাকারী পুলিশের সদস্যদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশে জনগণের ট্যাক্সে বেতনধারী কর্মচারীরা সেই জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বিষয়ে দায়ীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করার সময় আসছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, এসব প্রমাণ ও নথি প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করা হবে। তথ্যগুলো আন্তর্জাতিক মহলেও তুলে ধরা হবে।
বিএনপি পুলিশ সদস্যদের তালিকা করে বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রের দূতাবাস কিংবা বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থায় দিয়েছে কিনা কিংবা দেবে কিনা– জানতে চাইলে বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের চেয়ারম্যান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল বলেন, ‘এ বিষয়ে দল সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার রক্ষায় গণতান্ত্রিক বন্ধু রাষ্ট্র, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও এটা জানতে চায়। এসব রাষ্ট্র ও সংস্থা নিজেদের মতো করে তথ্য সংগ্রহ করে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের তালিকা করে বিদেশিদের কাছে নালিশের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক জানান, বিএনপি এখন দিক হারিয়ে যাচ্ছেতাই করছে। বিএনপি এ রকম তালিকা করে রাষ্ট্রের ভেতরে আতঙ্ক তৈরি করতে চায়। কিন্তু রাষ্ট্র কখনও আতঙ্কিত হবে না। রাষ্ট্র সব সময়ে নিজস্ব দায়িত্ব পালন করবে।
সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলেন, পুরো বিষয়টি বেশ দুর্ভাগ্যজনক। একটি রাজনৈতিক দল কেন, কীভাবে এ তালিকা প্রণয়ন করেছে– সে সম্পর্কে তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। যদি তারা (বিএনপি) অভিযোগ করে তাদের কোনো নেতাকর্মী গুম, খুন হয়েছেন এবং এর পেছনে কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সম্পৃক্ত রয়েছেন– তাহলে তারা থানায় মামলা করতে পারত। থানায় মামলা না নিলে আদালতে যেতে পারতেন। নিম্ন আদালত মামলা না নিলে উচ্চ আদালতে যেতে পারতেন। দেশের আইনি পরিকাঠামোর মধ্যে না হেঁটে তারা যে পথে গেছে তাতে প্রতীয়মান হয়– আইন ও বিচার কাঠামোর ভেতরে হয়তো কখনও কখনও বিচ্যুতি ঘটেছে বা তাদের আইনের প্রতি আস্থাশীল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়গুলো বিদেশি বন্ধুদের কাছে তুলে ধরলে অনেক সময় তারা আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে থাকেন। এ পুরো বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে সারাদেশে দলের ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৪৮টি জেলা ও মহানগরের তথ্য সংগ্রহ করেছে দলটি। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পুলিশের সর্বোচ্চ পদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন থানায় কর্মরত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও এসআই পর্যন্ত সারাদেশে ৬৩২ জনের তালিকা করেছে। এ তালিকা জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের ঢাকার দূতাবাসে দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব কর্মকর্তা অনিয়ম ও কারচুপিতে সহায়তা করেছেন, তাঁদের একটি পৃথক তালিকাও তৈরি করেছে বিএনপি। সেই তালিকাও বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে দাবি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক গতকাল বলেন, দেশে সরকার আছে, আদালত আছে; কেউ সুবিচার চাইলে তো দেশেই সম্ভব। তারপরও যদি কেউ দেশের বাইরে নালিশ করতে যায়, তাহলে বুঝতে হবে তাদের দেশপ্রেমের ঘাটতি আছে। তালিকা তারা করতেই পারে, তবে এত দিন পর কেন সেটা মনে হলো? এত দিন কেন তারা তালিকা করেনি? আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, পুলিশ কোনো গুম-খুন-নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত নয়। পুলিশ মামলা করতে পারে, আসামি গ্রেপ্তার করতে পারে। তাদের তো আইনের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ কেউ আইনের ঊর্ধ্বে না, পুলিশও নয়। যদি পুলিশের কোনো অপরাধের প্রমাণ থাকে, তাহলে আদালত তার বিচার করবেন।
বিএনপি সূত্র জানায়, তালিকার মধ্যে নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, ভোলা এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণে বিভিন্ন সময়ে মামলা-হামলা, গুম-খুনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি নাম এসেছে। এদের অধিকাংশই এখন পদোন্নতি পেয়ে পুলিশের বিভিন্ন বড় পদে কর্মরত। তালিকায় কর্মকর্তাদের মধ্যে সবার উপরে পুলিশের দু’জন সাবেক আইজিপি, সাবেক ও বর্তমান অতিরিক্ত আইজিপি, সাবেক ডিএমপি কমিশনার, বর্তমান কয়েকজন যুগ্ম কমিশনার, সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন ডিএমপির ডিসি, সাবেক ও বর্তমান ডিবির ডিসিসহ বিভিন্ন জেলার সাবেক ও বর্তমান পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), তদন্ত কর্মকর্তা, এসআইসহ ৬৩২ পুলিশ সদস্যের নাম রয়েছে।
দলীয় সূত্রে দাবি করা হয়, তালিকায় সাবেক আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপি ক্যাটাগরিতে আছেন ৯৬ জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এ ছাড়া ইন্সপেক্টর থেকে সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ে রয়েছেন ৫৩৬ জন। ২০০৯ সাল থেকে সংগ্রহকৃত এ তালিকায় চিহ্নিত কর্মকর্তার বিস্তারিত তথ্যের পাশাপাশি কার নির্দেশে, কী উদ্দেশ্যে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের আজ্ঞাবাহ হিসেবে এসব অপকর্মের জন্য তাঁকে পরে কী ধরনের পুরস্কার দেয়া হয়েছে, তার বিবরণও রয়েছে ওই তালিকায়। তালিকায় ঘটনার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন, অডিও-ভিডিও উপস্থাপন করা হয়েছে। অনেক কর্মকর্তার রাজনৈতিক বক্তব্যকেও সামনে আনা হয়েছে।
বিএনপির দপ্তর সূত্র আরও জানায়, সারাদেশে আরও ‘বিতর্কিত’ পুলিশ কর্মকর্তার তালিকা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছে দলের হাইকমান্ড। কয়েক দিনের মধ্যে বাকি কাজও সম্পন্ন করে জমা দেবে তারা। এরপর প্রশাসনের অন্যান্য বিভাগের বিএনপির ভাষায় ‘বিতর্কিত’ কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করবে তারা।
বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, গায়েবি মামলা, মিথ্যা মামলা, গুম, খুন, সহিংস আক্রমণ, অগ্নিসংযোগসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বাধা প্রদানকারীদের তথ্যাদি সংগ্রহ করতে ‘তথ্য সংগ্রহ কমিটি’ গঠন করেছে বিএনপি। এই কমিটি সহিংসতায় লিপ্ত ব্যক্তিদের নাম ও ভিডিও-অডিও রেকর্ড, ফটোগ্রাফ ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে।
বিএনপির দাবি, ২০০৯ সাল থেকে সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১ লাখ ১১ হাজার ৫৬৭টি মামলায় ৩৯ লাখ ৮০ হাজার ৮২৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে হত্যার শিকার হতে হয়েছে ১ হাজার ৫৩৭ জনকে। তাঁদের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ২ হাজার ৮৩০টিরও বেশি। ঢাকাতেই ১ হাজার ৫০০ মামলা হয়েছে।
এসব মামলায় বিরোধী মত ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এ সময় সারাদেশে দলটির ৭৯৯ জন নেতাকর্মীকে হত্যা ও বিভিন্ন দলের ১ হাজার ২০৪ জনকে গুম করা হয়েছে। গুমের মধ্যে ৭৮১ জনকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। শুধু বিএনপি নেতাকর্মীর মধ্যে এখন পর্যন্ত গুম রয়েছেন ৭২ জন। এখনও কারাগারে আটক প্রায় ৩ হাজার।
বিএনপির করা তালিকায় দেখা যায়, ২০১৫ সালে ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনি হত্যার ঘটনায় ওই সময়ের মহানগর পুলিশের একজন উপকমিশনারসহ ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত পুলিশ কর্মকর্তার নাম রয়েছে। নীলফামারী জেলায় কথিত ক্রসফায়ারের নামে যুবদল নেতাদের হত্যার ঘটনায় জড়িতদের নাম রয়েছে, তেমনি গত বছর মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ভোলায় ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীর ঘটনাও রয়েছে। সেখানে বন্দুক উঁচিয়ে গুলি করার ছবি, ভিডিওকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
তথ্য সংগ্রহ কমিটির একজন নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, এসব কর্মকর্তা গুম, খুন, হামলা, মামলার সঙ্গে জড়িত। যার যথাযথ প্রমাণাদি তাঁদের হাতে এসেছে। ওইসব কর্মকর্তা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পরিবারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এমনকি সেই অভিযোগ যাচাই-বাচাই করার পরই এ তালিকা করা হয়েছে। এসব কর্মকর্তা তাঁদের কৃতকর্মের মাধ্যমে সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন– দেশের প্রচলিত আইনসহ পৃথিবীর সব আইনেই তাঁরা দোষী। যেসব পুলিশ কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে, তাঁরা সবাই কমবেশি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট অনিয়মের সঙ্গে জড়িত।
তথ্য সংগ্রহ কমিটির সদস্য এবং সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা সালাউদ্দিন খান বলেন, সারাদেশ থেকে তাঁদের কাছে তথ্য-প্রমাণ আসছে। তবে কোনো ব্যক্তি বা কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করব না এখন।
গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থায় জালিয়াতি ও অনিয়মের সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে সেই ব্যক্তিকে ভিসা দেবে না ওয়াশিংটন। এ নীতির আওতায় থাকবেন বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও এর আওতাভুক্ত হবেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাঁদের মতামত প্রকাশে বাধা দিলেও ভিসা পাবে না জড়িত ব্যক্তি। সমকাল
সোনালী/জেআর