ঢাকা | নভেম্বর ২৫, ২০২৪ - ১১:৫৯ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের নির্বাচন ও ভারতীয় গণমাধ্যমের সক্রিয়তা

  • আপডেট: Tuesday, August 22, 2023 - 5:00 pm

♦আমেরিকার বর্তমান ভূমিকায় খুশি নয় ভারত || জি-২০ সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে দুটি স্পষ্ট বার্তা দেয়ার ইঙ্গিত মোদি সরকারের 

(অনলাইন) বিশেষ ডেস্ক: বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে। দেশের এই নির্বাচন নিয়ে সরগরম হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ভারত ইতোমধ্যে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। এর মাঝেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম।

গতকাল সোমবার দেশটির প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ এবং দ্য হিন্দু এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দ্য হিন্দুকে ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে বহির্বিশ্ব।

এর ঠিক একদিন আগেই রোববার বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য হিন্দুর ম্যাগাজিন ফ্রন্টলাইন। এর আগে গত ১৮ আগস্ট একই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা। সেখানে বলা হয়, “শেখ হাসিনাকে দুর্বল করলে ক্ষতি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের।”

দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়, জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য আগামী মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় দুটি স্পষ্ট বার্তা দিতে পারে ভারত। তা হলো, বাংলাদেশে আসন্ন সাধারণ নির্বাচন অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে এবং তার দল আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক ও জনপ্রিয় প্রার্থীদের বেছে নিতে হবে।

ভারতের নিরাপত্তা সংস্থার একটি সূত্র বলছে, শেখ হাসিনাকে এই দুটি বার্তা বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন প্রশ্নে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক ঐকমত্যের ইঙ্গিত দেয়।

সূত্র বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দুই দেশের (ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র) নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে ধারাবাহিক আলোচনা হয়েছে। এসব বৈঠক ভারত এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন জি-২০ সম্মেলনের জন্য দিল্লিতে থাকবেন, তখন তাকে বার্তা এই দুটি পৌঁছে দেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের সবশেষ নির্বাচন ঘিরে ওঠা অভিযোগ নিয়ে কখনও কোনও প্রশ্ন তোলেনি নয়াদিল্লি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই প্রথম শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ৯৬ শতাংশের বেশি আসন পায়। সাধারণ ধারণা হলো, বাংলাদেশের নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে ভারত ততক্ষণ চিন্তা করবে না যতক্ষণ ফলাফল শেখ হাসিনার পক্ষে থাকে; যাকে নয়াদিল্লি সর্বদা তার প্রতিবেশীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে।

ঢাকাস্থ এক কৌশলগত বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘তিনি (হাসিনা) এখনও ভারতের প্রিয় রয়ে গেছেন তাতে সন্দেহ নেই… তবে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন কৌশলগত উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ভারতের উদ্বেগের সমাধান না করলে নয়াদিল্লি তাকে সমর্থন দেবে, এমন সম্ভাবনা নেই।’

মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের দমন থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে পণ্য চলাচলের অনুমতি দিয়ে ভারতের অনেক ইচ্ছা পূরণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। তবে চীনের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের নৈকট্য নয়াদিল্লির উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে একই অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

আমেরিকা ও ভারত উভয় পক্ষই দ্ব্যর্থহীনভাবে একমত হয়েছে যে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। শেখ হাসিনার সফরে ভারত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের অন্যতম প্রধান দাবি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান না থাকায় বিষয়টি নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ নেই।

শেখ হাসিনা সরকারকে দুর্নীতি এবং ব্যাংক খেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে বলে উভয় পক্ষেরই ঐকমত্য রয়েছে। পাশাপাশি সরকারকে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে; যা সাধারণ বাংলাদেশিদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে।

ভারতীয় কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা পরিবর্তনের প্রাথমিক এজেন্ডা বিএনপি-জামায়াত জোটকে ক্ষমতায় আনবে এবং এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। ভারতীয় পক্ষ মার্কিন প্রতিনিধিদের যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কে তাদের আপত্তির কথা জোরালোভাবে জানিয়েছে। তারা বলেছে, জামায়াতে ইসলামি একটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক সংগঠন। ভারত জামায়াতকে একটি উন্মত্ত মৌলবাদী সংগঠন বলে মনে করে।

বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে জো বাইডেন প্রশাসন কর্তৃক ঘোষিত বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ করা উচিত বলে নয়াদিল্লির প্রতিনিধিরা মার্কিন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।

একাধিক সূত্র জানায়, আসন্ন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির এমন মিল কেবল বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের অতীতের পার্থক্যের কারণে নয়।

ঢাকার একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করবে। তরুণ প্রজন্ম যারা রাজনীতিতে আগ্রহী নয়, তাদেরও দেশ গঠনের প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে উৎসাহিত করবে। ক্ষমতাসীন দলের কোনও চক্রের প্রতি আনুগত্য নয়, জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী করবে। অবশেষে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সূত্রটি আরও জানায়, এখন প্রশ্ন হলো শক্তিশালী নেতা শেখ হাসিনা, যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে, তিনি এসব পরামর্শ মানবেন কিনা।

এদিকে আসন্ন নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ভারত সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে দেশটির প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য হিন্দু।

গতকাল সোমবার পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এই মন্তব্য করা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি উচ্চ-পর্যায়ের প্রতিনিধিদলকে আমন্ত্রণ জানানোর কয়েকদিন পর ভারত ঢাকার রাজনৈতিক মহলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নেতৃত্বে একটি দলকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ভারতের পক্ষ থেকে। জি এম কাদের বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সর্বদলীয় সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন।

দ্য হিন্দু বলছে, জাতীয় পার্টির এই প্রতিনিধিদলের সফর তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ আসন্ন জি-২০ সম্মেলনে ভারত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আতিথ্য দেয়ার পরিকল্পনা করছে। এতে বাংলাদেশকে ‘অতিথিদেশ’ হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কেন্দ্রে আছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি।

এতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আসন্ন নির্বাচন যথাসময়ে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই করার ওপর জোর দিয়ে আসছে। ২০১১ সালে সংসদীয় আইনের মাধ্যমে এই তত্ত্বাবধায় সরকার বাতিল হয়ে যায়।

টেলিফোনে হিন্দুকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জি এম কাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এবং বিএনপি উভয়ের মধ্যেই সমদূরত্ব তৈরি করে বলেন, ‘সরকারের জন্য সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে এগিয়ে আসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই সব পক্ষ বসে আলোচনা করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার উপায় নিয়ে আলোচনা করুক।’

জি এম কাদের অবশ্য বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেননি। তিনি বলেন, ‘তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য জোর দিয়ে আসছে কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক গঠন ঠিক কেমন হওয়া উচিত তা স্পষ্ট করেনি।’

জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের মনে একটি সূত্র আছে এবং আমরা যখন সর্বদলীয় সংলাপ হবে তখন আমরা তা টেবিলে রাখব।’এদিকে রোববারই দিল্লি পৌঁছেছেন জিএম কাদের।ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আমন্ত্রণে তার এই এই সফর।

এর এক দিন আগে রোববার দ্য হিন্দুর ম্যাগাজিন ফ্রন্টলাইনে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী নির্বাচনে যদি শেখ হাসিনা হেরে যান, তাহলে বাংলাদেশ দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হতে পারে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার যদি ক্ষমতা হারায়, তাহলে এতে ‘চিন্তিত’ হয়ে পড়বে ভারত। এ ঘটনায় দক্ষিণএশিয়ায় আঞ্চলিক সহিংসতাও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবেশীদের মধ্যে যে ভারতবিরোধী মনোভাব আছে সেখানে শেখ হাসিনার সরকার খুব সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে নির্ভরশীল ও ঘনিষ্ঠ মিত্র।

এর আগে পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার দুর্বল হলে তা ভারত এবং আমেরিকা কারও পক্ষেই সুখকর হবে না বলে মনে করে নয়াদিল্লি। বাইডেন প্রশাসনকে একাধিক বৈঠকে নয়াদিল্লি এ কথা জানিয়েছে।

বাংলাদেশের আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার বর্তমান ভূমিকায় ভারত যে খুশি নয়, ওয়াশিংটনকে দেয়া হয়েছে সেই বার্তাও। ঢাকায় সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হোক এটা ওয়াশিংটনের মতো ভারতও চায়। কিন্তু যেভাবে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আমেরিকার তরফ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে, তা প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক নয় বলে মনে করে নয়াদিল্লি।

তিন সপ্তাহ পরই নয়াদিল্লিতে এক বৈঠকে বসবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আগে ভারতের এই বার্তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘতম স্থলসীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের।

ফলে সে দেশের যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতি ভারতেও প্রভাব ফেলে। আমেরিকা জামাতকে বরাবর রাজনৈতিক ইসলামিক সংগঠন হিসেবেই দেখানোর চেষ্টা করে। মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গেও তাকে তুলনা করে আমেরিকা।

সোনালী/জগদীশ রবিদাস