ডিসি পদে বড় রদবদলের চিন্তা সরকারের
অনলাইন ডেস্ক: জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অন্তত ২৫ জেলা প্রশাসক (ডিসি) রদবদলের চিন্তা করছে সরকার। এর মধ্যে ২০ থেকে ২২ জনকে মাঠ পর্যায় থেকে সরিয়ে আনা হতে পারে। দুই-তিনজনের হতে পারে জেলা বদল। ২০ জন ডিসি মেয়াদ পূর্ণ করে ফেলায় তাঁদের সরিয়ে আনার স্বাভাবিক সময় হয়ে গেছে। এ ছাড়া মেয়াদ পূর্ণ না করলেও অদক্ষতার কারণে দু’একজনকে মাঠ পর্যায় থেকে ফেরানো হতে পারে।
সিটি করপোরেশনগুলোর চলমান নির্বাচনের পরই নতুন ডিসি নিয়োগের চিন্তা চলছে বলে জানা গেছে। তবে দুই ধাপে ডিসি বদল হলেও এখন যেসব জায়গায় নির্বাচন নেই, তাঁদের বিষয়টা প্রথমে বিবেচনা করা হতে পারে।
বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ২০টি জেলায় কর্মরত প্রশাসনের ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। ২৪ ব্যাচের ২৯ জন এবং ২৫ ব্যাচের ১৫ জন ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমান ডিসিদের মধ্যে ২২ ব্যাচের কর্মকর্তারা সবচেয়ে সিনিয়র। তাঁদেরকে পদায়নের সময় দুই থেকে তিন বছর হতে যাচ্ছে। সাধারণত ডিসি হিসেবে এ সময়কেই স্বাভাবিক ধরা হয়। যদিও এর চেয়ে কম সময়ে অনেককে মাঠ পর্যায় থেকে ফেরানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২২ ব্যাচের কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব হওয়ার সময় এগিয়ে এসেছে। তাই এ ব্যাচের যাঁরা ডিসি আছেন তাঁদের প্রত্যাশা, যুগ্ম সচিবে পদোন্নতির পর যেন মাঠ থেকে সরানো হয়। কিন্তু ১৭ ব্যাচের যুগ্ম সচিবদের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় অনেক বেশি সময় চলে গেছে। ফলে ২২ ব্যাচের কর্মকর্তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পদোন্নতি প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। তাই তাঁদেরকে যুগ্ম সচিবে পদোন্নতি দিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে সরাতে গেলে নতুন ডিসিদের পদায়ন অনেক দেরি হয়ে যাবে বলে মনে করছেন প্রশাসনের নীতিনির্ধারকরা।
ডিসি পদে উপসচিবদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্রমতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় আছে ৮ মাসের মতো। নির্বাচনের অন্তত ৬ মাস আগে ডিসিদের পদায়ন হওয়া উচিত। একজন ডিসি যদি তাঁর দায়িপ্রাপ্ত জেলার সামগ্রিক বিষয় সম্পর্কে কাজের মাধ্যমে পূর্ণ ধারণা অর্জন না করেন, তাহলে তাঁর পক্ষে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামলানো কঠিন হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২২ ব্যাচের কর্মকর্তা যাঁরা ডিসি হিসেবে আছেন তাঁদেরকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি প্রক্রিয়ার পর মাঠ পর্যায় থেকে তুলে আনার একটি চিন্তা ছিল। এখন সেটি সম্ভব কিনা, ভেবে দেখা হচ্ছে। এর আগে একাধিক ব্যাচের ডিসি কেউ কেউ যুগ্ম সচিবে পদোন্নতি পাওয়ার পরও কিছুদিন ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন।
মেয়াদ পূর্ণ করা ২২ ব্যাচের ডিসিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছেন চট্টগ্রাম বিভাগে। এ বিভাগে কুমিল্লা জেলায় শামীম আলম, ফেনীতে আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান, লক্ষ্মীপুরে আনোয়ার হোছাইন আকন্দ, বান্দরবানে ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি ও রাঙামাটিতে মিজানুর রহমান ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। খুলনা বিভাগে– যশোর জেলায় তমিজুল ইসলাম খান, বাগেরহাটে আজিজুর রহমান, কুষ্টিয়ায় সাইদুল ইসলাম ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা বিভাগে– ঢাকা জেলায় মমিনুর রহমান, নারায়ণগঞ্জে মঞ্জুরুল হাফিজ, টাঙ্গাইলে জসীম উদ্দীন হায়দার, শরীয়তপুরে ডিসি পারভেজ হাসান রয়েছেন। বরিশাল বিভাগে– বরিশাল জেলায় জাহাঙ্গীর হোসেন, ভোলায় তৌফিক-ইলাহী চৌধুরী, পটুয়াখালীতে শরীফুল ইসলাম ও বরগুনার ডিসি রয়েছেন হাবিবুর রহমান। সিলেট বিভাগে– সিলেট জেলায় মজিবর রহমান, হবিগঞ্জে ইশরাত জাহান; ময়মনসিংহ বিভাগে– নেত্রকোনায় অঞ্জনা খান মজলিস; রাজশাহী বিভাগে– পাবনা জেলায় বিশ্বাস রাসেল হোসেন ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ব্যতিক্রম না হলে তাঁদের সবাইকে একই সঙ্গে মাঠ পর্যায় থেকে সরিয়ে আনা হতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
তবে ২২ ব্যাচের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার যদি মনে করে তাহলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ করেও সরিয়ে আনতে পারে। তাঁরা যুক্তি দিচ্ছেন, দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকায় সংশ্লিষ্ট জেলা সম্পর্কে তাঁদের ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে। নির্বাচনী ঝামেলা মোকাবিলায় তাঁরা দক্ষতা দেখাতে পারবেন। নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের জন্য তা কঠিন হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সমকালকে বলেন, ‘কর্মকর্তাদের পদোন্নতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ডিসিদের বদলি বা পরিবর্তনের সঙ্গে পদোন্নতির কোনো সম্পর্ক নেই। নতুন ডিসি নিয়োগের সময় হয়ে এসেছে। যথাসময়ে প্রজ্ঞাপন দেখতে পাবেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো পরিবর্তন নয়। ডিসি-ইউএনও পদে দুই-তিন বছরের মধ্যে পরিবর্তন করা হয়। তাই একে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলতে পারেন। কাউকে যদি এর আগেই পরিবর্তন করা হয়, সেটাও প্রশাসনের নিয়মিত কাজের অংশ।
প্রশাসনের কোন ব্যাচ থেকে কতজন ডিসি হতে পারছেন, তার ওপর ব্যাচের গুরুত্ব বিবেচনা করা হয় বলে অনেকে মনে করেন। যে ব্যাচের ডিসি বেশি, সেই ব্যাচ তত শক্তশালী হিসেবে বিবেচিত হয়। এখন ডিসি করার ক্ষেত্রে বিবেচনায় আছে প্রশাসনের ২৫ এবং ২৭ ব্যাচ। এর মধ্যে ২৫ ব্যাচ থেকে ১৫ জন কর্মকর্তা ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। রীতি অনুযায়ী এ ব্যাচ থেকে আরও কয়েকজন কর্মকর্তার ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কথা। কিন্তু এ ব্যাচটি বিএনপি সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়ায় নির্বাচনের আগে তাঁদের মধ্য থেকে কমসংখ্যক ডিসি নিয়োগ দেওয়ার তদবির করছেন কেউ কেউ।
অন্যদিকে ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে এবারই প্রথম ডিসি নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন। এ ব্যাচের নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তবে ২৭ ব্যাচের ডিসি ফিটলিস্ট তৈরির কাজ এখনও শেষ হয়নি বলে জানা গেছে।
বর্তমানে ২৪ ব্যাচের সবচেয়ে বেশি ডিসি থাকলেও এ ব্যাচ থেকেও দু’একজন ডিসির পদায়ন পেতে পারেন, এমন আভাসও মিলেছে। এসব বিষয়ে কর্মকর্তারা প্রকাশ্য মন্তব্য করতে রাজি হননি। ডিসি হতে আগ্রহী এমন অন্তত তিন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে।
তাঁদের একজন বলেন, সরকার যাঁদের যোগ্য মনে করবে, তাঁদেরই নিয়োগ দেবে– এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যোগ্য কর্মকর্তাদের যেন দলীয় রং দেওয়া না হয়। অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, এখন প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে যাঁদের মুখ চেনা থাকে, তাঁরাই বেশি গুরুত্ব পান। প্রশাসনের সব কর্মকর্তা শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজের সুযোগ পান না। যথাযথ বিবেচনার মাধ্যমে যোগ্য কর্মকর্তাদের বাছাই করা উচিত।
ডিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় খুবই গোপনীয়তা রক্ষা করে। প্রজ্ঞাপন জারির আগ পর্যন্ত এ সংক্রান্ত নিয়োগ তালিকা সময়ে সময়ে বদলেও যায়। আবার প্রজ্ঞাপন জারির পরও বাদ পড়েন কোনো কোনো কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, ডিসি হিসেবে যাঁরা স্বাভাবিক মেয়াদ পূর্ণ করেছেন, তাঁদের শিগগিরই সরিয়ে আনা হবে। এটাকে নির্বাচনী প্রশাসন সাজানোর পরিকল্পনা বলা যাবে না। এখন যাঁরা ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাবেন তাঁরাই জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন।
এদিক থেকে বলা যায়, কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচনী চাপ সামলানোর ক্ষমতার বিষয়টি নিশ্চয় নীতিনির্ধাকরদের বিবেচনায় থাকবে।
সোনালী/জেআর