নাকাল অবস্থা সাধারণ মানুষের
জগদীশ রবিদাস: গতকাল থেকে শুরু হয়েছে সংযমের মাস পবিত্র রমজান। এ মাসে কিছু দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাসিক খরচেও একটি বড় প্রভাব পড়ে। এতে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাড়ায় দ্রব্যমূল্যের ঊধ্বগতি। সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পেলেও বাড়ছে না শুধু মানুষের আয়। এমন পরিস্থিতে নগর কেন্দ্রীক জীবনে টিকে থাকাটাই যেন দুষ্কর! সবমিলে ভালো নেই নিম্ন-মধ্য আয়ের সাধারণ মানুষ। তারা এখন সবচে নাকাল অবস্থায়।
৪৫ বছর বয়সী তুহিনা বেগমের সংসারে সব মিলিয়ে প্রতি মাসে আসে ১৮ হাজার টাকা। এ টাকায় দুই ছেলে-মেয়ের পড়ালেখাসহ খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য খুব হিসেবে করে খরচ করতে হয় তাকে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে নিত্যপণ্যের বেশামাল অবস্থায় অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার সাহেব বাজার জিরোপয়েন্ট এলাকায় খোলা বাজারের ট্রাক থেকে চাল ও আটা কিনতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে। ১৩১ টাকা বাঁচাতে ৫ কেজি চাল এবং ৩ কেজি আটা কিনতে টানা রোদে প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তুহিনা বেগম বলেন, ‘এটা আমার জন্য বিব্রতকর। তবে, এছাড়া অন্য কোনো বিকল্পও নেই আমার।’
ওএমএসের এক ট্রাক ডিলার শাহীদ হোসেন শিশির জানান, ১ কেজি চালের দাম ৩০ টাকা। খোলা বাজারে যার মূল্য ৪৫ থেখে ৫০ টাকা। এতে সাশ্রয়ী হয় ১৫ থেকে ২০ টাকা। একইসঙ্গে, ট্রাকে ১ কেজি ময়দার দাম ২৪ টাকা। বাজারে ময়দার কেজি এখন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। প্রতি লিটার তেল ট্রাকের ক্ষেত্রে হয় ১১০ টাকা। খোলা বাজারে দাম ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকা। ট্রাকে ছোলা দেয়া হয় ৫০ টাকা আর বাজারে গুনতে হয় ৮৫ থেকে ৯০ টাকা।
একই লাইনে তুহিনার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাগরপাড়া এলাকার গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম। তার সংসারের অবস্থা আরও খারাপ। অন্যান্য খরচ বহন করে তার ও তার দিনমজুর স্বামীর হাতে খাবারের জন্য টাকা বাঁচে খুব অল্প। এক শব্দে ফাতেমা বলে ওঠেন, ‘আমরা ক্ষুধার্ত’। তুহিনা ও ফাতেমার মতো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ খাবারের বাড়তি দামের সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা করছেন অনেক কিছু ত্যাগ করার মাধ্যমে।
এদিকে, প্রতি বছর রমজান মাস এলেই বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্যের দামে আগুন লাগে। এই রোজতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রোজা শুরু হওয়ার ক’দিন আগে থেকেই বেড়েছে অনেক দ্রব্যের দাম। ইফতারির সময় তৃষ্ণা মেটাতে শরবতে ব্যবহৃত লেবু বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রতি হালি ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। যার দাম এক সপ্তাহ আগেও ছিল মাত্র ১০ থেকে ১২ টাকা।
ইফতারিতে বেগুনি বানাতে যে লম্বা বেগুন ব্যবহৃত হয়, তার দাম প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। সাত-আট দিন আগেও এই বেগুনের দাম ছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা। শসা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে শসা মিলতো ২০ থেকে ৩০ টাকায়। মূল্য বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদেরই দুষছেন সাধারণ ক্রেতারা। রমজান মাসে এসবের দাম বাড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
শহরের সাহেব বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা দরে। আলু ১৮ থেকে ২০ টাকায়। কাঁচা মরিচ ও রসুনের দাম খানিকটা কমে এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা প্রতি কেজি। প্রতি হালি ডিম কিনতে হচ্ছে ৪০ টাকায়। নাগালের বাইরে গেছে ব্রয়লার মুরগির দাম। ১৫-২০ দিন আগে যে মুরগি পাওয়া যেত ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৩২০ কেজি দরে।
বাজার করতে আসা দরগাপাড়া নিবাসী ফয়েজ আলী বলেন, পণ্য মজুত আছে, সরবরাহ স্বাভাবিক এসব বলে বাণিজ্যমন্ত্রী আমাদের শুধু বুঝ দিচ্ছেন। বলা হলো, রোজার মাসে নাকি কোনো পণ্যের ঘাটতিও থাকবে না। দাম বৃদ্ধি করে কেউ যাতে পরিস্থিতি অশান্তি সৃষ্টি না করতে পারে সেই পদেক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তারপরও দেখতে হচ্ছে অনেক পণ্যের দাম রাতারাতি বেড়ে গেছে।ৎ
কাঁচা বাজারের সবজি বিক্রেতা জাহিদ উদ্দীন বলেন, যখন পাইকারি বাজারে সবজি কিনতে যাই, ওই সময় বাজারে যদি কাঁচামাল কম থাকে এবং ক্রেতার সংখ্যা অধিক হয় তখন পাইকাররা দাম বাড়িয়ে দেয়। এটি এখন নিয়ম হয়ে দাাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীরা চিন্তা করে না, দাম বাড়ালে সাধারণ মানুষের সমস্যা হয়। পাইকারি বিক্রেতারা তো ঠিকই বিক্রি করতে পারে। শুধু সমস্যায় পড়তে হয় আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের।
এদিকে, বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে প্রতিনিয়তই অভিযান চালাতে দেখা যাচ্ছে বাজার তদারকি সংস্থা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে। অনিয়ম দেখলে জরিমানা করতেও দেখা যাচ্ছে তাদের। জানতে চাইলে অধিপ্তরের রাজশাহী জেলার সহকারী পরিচালক মাসুম আলী বলেন, রমজান মাস শুধু নয়, প্রতিদিনই আমাদের অভিযান চলছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে তদারকিও অব্যাহত রয়েছে। ব্যবসায়ীদের মূল্য তালিকা প্রদর্শন করে পণ্য বিক্রি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যারাই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত দামে খাদ্যপণ্য বিক্রি করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সোনালী/জেআর