ঢাকা | মে ৩, ২০২৪ - ৪:৫৮ অপরাহ্ন

হঠাৎ ডাক্তার কেন টার্গেট?

  • আপডেট: Thursday, November 2, 2023 - 12:09 am

প্রশ্ন উঠেছে শহরের নিরাপত্তা নিয়ে — সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে; বলছেন পুলিশ কমিশনার

জগদীশ রবিদাস: আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিক দিয়ে অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় নগরী রাজশাহী। হত্যা, চুরি, ছিনতাইসহ এলাকাভিত্তিক সংঘর্ষ অন্যান্য শহরের তুলনায় রাজশাহীতে অনেকটাই কম। কিন্তু মাত্র তিন থেকে চার ঘণ্টার ব্যবধানে দুই চিকিৎসক খুন ও একজন আহতের ঘটনায় নিরাপত্তাজনিত সার্বিক পরিস্থিতি যেন নড়েচড়ে বসেছে। একই রাত, মাঝে শুধু তিন-চার ঘণ্টার ফারাক। হত্যার ধরনও এক। যারা হত্যার শিকার হয়েছেন, তারা দু জনেই রাজশাহীর চিকিৎসক। এসব ঘটনার কিছুক্ষণ না পেরোতেই ঘটে আরেক ঘটনা। মারধরের শিকার হয়ে আহত হন শহরের আরেকজন চিকিৎসক। তিনি রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি হন।

মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলোর পর সাধারণভাবেই প্রশ্ন উঠেছে রাজশাহীর চিকিৎসকরাই কেন দুর্বৃত্তদের টার্গেট? এর পেছনের কারণ কি? এসব নিছক শুধু হত্যাকাণ্ড, নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোন রহস্য! অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব হত্যাকাণ্ডকে একভাবে দেখলে চলবে না। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে পারিবারিক কলহ, পূর্ব শত্রুতা, রাজনৈতিক মতবিরোধের মতো কারণ থাকতে পারে। আবার বিচ্ছিন্ন ঘটনাও হতে পারে। তবে গত কয়েকমাসে অপরাধ সংক্রান্ত পরিস্থিতির সার্বিক পর্যালোচনা করে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়নি- একথা বলার কোন সুযোগ নেই। তবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বলছেন, এসব ঘটনার সঙ্গে শহরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘অবনতির’ কোন সম্পর্ক নেই। হত্যাকাণ্ডগুলো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। পুলিশ এটিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। নগরবাসীর এতে আতক্সিকত হওয়ার কিছু নেই।

জানা গেছে, গত রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর সিটি হাট এলাকার একটি ড্রেনের পাশ থেকে পল্লিচিকিৎসক এরশাদ আলী দুলালের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত এরশাদ আলী মহানগরীর চন্দ্রিমা থানা এলাকার বাসিন্দা এবং পল্লিচিকিৎসক। অপরদিকে, ওইদন রাতেই প্রায় পৌনে ১২টার দিকে চেম্বার শেষে বাড়িতে ফেরার পথে নগরীর বর্ণালীর মোড়ে ছুরিকাহত হন ডা. গোলাম কাজেম আলী। পরে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কিছুক্ষণ পরই তার মৃত্যু হয়। অন্যদিকে, চিকিৎসককে হত্যার একদিন পর সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে মোহাম্মদ রাজু আহমেদ (৪৫) নামের আরেক চিকিৎসকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। মহানগরীর তালাইমারী মোড়ে আমেনা ক্লিনিকে ওই চিকিৎসকের চেম্বারে হামলার ঘটনা ঘটে। আহত চিকিৎসক রাজুকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার স্ত্রী ডা. উম্মে কাউসার জাহান।

মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুইটি খুনের ঘটনা জানাজানি হলে শহরের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন নেটিজেনরা। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শহরের নিরাপত্তা নিয়ে সমালোচনা করেন। ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান চিকিৎসক নেতারা। একই সঙ্গে নগরীর সব প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী দেখাও বন্ধ রাখেন চিকিৎকরা। হঠাৎ চিকিৎসকরাই কেন ‘দুর্বৃত্তদের টার্গেট’ জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. নওশাদ আলী বলেন, ডাক্তাররা কেন টার্গেট হচ্ছেন এটি সঠিকভাবে বলা মুশকিল। এর বিভিন্ন মোটিভ থাকতে পারে। চিকিৎসকদের কাছে তো সব ধরনের মানুষই আসেন। অনেক সময় সকলকে সন্তুষ্ট করা যায় না। এতে চিকিৎসকদের ওপর অনেকের অসন্তুষ্টি থেকে যায়। সেখান থেকেও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।

তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে, রাজশাহীসহ সারাদেশেই ডাক্তাররা কিন্তু অন্যান্য কমিউনিটি থেকে ভালো আছে। টাকা-পয়সাও ভালো ইনকাম করছে। এটিও মানুষের একটি ক্ষোভ হতে পারে। আবার কোন রোগীকে চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে সেই রোগী যদি মারা যান, সেখানেও স্বজনদের একটি রাগ বা ক্ষোভ থেকে যেতে পারে। আর রাজনৈতিক ব্যাপার তো রয়েছে। রাজশাহীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে কিনা প্রশ্ন করলে চিকিৎসক এই নেতা বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহীতে বসবাস করি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, এমনটি মনে করি না। বরং চিকিৎসকদের কোন নিরাপত্তা নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমরা সব জায়গাতেই ইনসিকিউর। কোন জায়গাতেই আমাদের নিরাপত্তা নেই। কর্মস্থলে বলেন, হাসপাতালে বলেন, প্রাইভেট সেক্টরে বলেন, কোথাও আমাদের নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা নেই। আমরা আহ্বান জানাই- এমন কোন আইন বা বিধান তৈরি করা হোক, যাতে করে একজন চিকিৎসক নির্দ্বিধায় নির্ভয়ে একজন রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করতে পারেন। এছাড়াও সম্প্রতি যে দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

এদিকে শুধুমাত্র এই হত্যাকাণ্ড নয়, বিগত কয়েকমাস ধরেই নগরীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে দাবি করে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নেতা আহমেদ শফি উদ্দীন বলেন, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে- গত তিন বছর আগে পুরো রাজশাহীকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় এনে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়েছিল। যেটার জন্য রাজশাহী শান্তিনগরী হিসেবে বাইরে খুব সুনামও অর্জন করেছিল। হত্যাকাণ্ড, ছিনতাই এসব অনেকাংশেই কমে এসেছিল। গভীর রাত পর্যন্ত মানুষ নির্ভয়ে ঘোরাফেরা করতে পারছিল। এমনকি মহিলারাও বাইরে বেরোতে পারতেন। এটি কিন্তু বিদ্যমান ছিল। আমরা নিজেরাই দেখেছি। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে অবস্থার এই অবনতি হলো কেন? প্রথম অনুসন্ধান হওয়া উচিত, এই সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো মনিটরিং কি হচ্ছে না, না বন্ধ আছে। কারণ এটি আমাদের শহরের নিরাপত্তার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিয়ে আমাদের প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধি যারা আছেন, সকলেরই একটি সমন্বিত উদ্যোগ থাকা দরকার।

দুই খুনের ঘটনায় মানুষ আতঙ্কিত কিনা প্রশ্ন করলে আহমেদ শফী বলেন, এই দুইটি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে অবশ্যই রাজশাহীবাসী আতক্সিকত। আপনি দেখেন- গত কয়েক মাসে কি পরিমাণ ছিনতাই বেড়েছে। শহরের অলিতে-গলিতে বাইরের ছাত্রদের জিম্মি করে ছিনতাই করে সবকিছু কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এভাবে তো চলতে পারে না।

অন্যদিকে, শহরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি পুলিশের নিয়ন্ত্রণেই আছে দাবি করে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, সম্প্রতি যে দুটি ঘটনা ঘটেছে এতে করে রাজশাহী শহরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, কথাটি সঠিক নয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোটাই রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আছে। খুন বা হত্যাকাণ্ড এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এর সাথে নিরাপত্তার মূল পরিস্থিতির কোন সম্পর্ক নেই। আপনি দেখুন, মানুষ নির্দ্বিধায়-নির্বিঘ্নে রাস্তায় চলাচল করছে। চলমান হরতাল অবরোধেও মানুষকে আটকে রাখা যাচ্ছে না। তারা তাদের স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং নিরাপত্তা নিয়ে শহরে কারো মধ্যে কোন অস্বস্তিবোধ আছে বলে মনে করি না।

মানুষের নিরাপত্তায় পুলিশ সার্বক্ষণিক কাজ করছে উল্লেখ করে মহানগর পুলিশের এই কমিশনার আরও বলেন, ২০১৩-১৪ সালে হরতাল-অবরোধের সময় রাজশাহীতে যেমন পরিস্থিতি ছিল, এখন কিন্তু সেই পরিস্থিতি নেই। মানুষ কিন্তু নির্ভয়েই নিজেদের কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং পুলিশ কাজ করছে বলে বা আমাদের কর্মকর্তারা জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন বলেই বর্তমানে রাজশাহী শান্তির নগরী। আমরা পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি সক্ষম ও দক্ষ। সর্বোপরি মহানগর পুলিশ তার কাজের মধ্য দিয়ে রাজশাহীর মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে।

দুই চিকিৎসক খুনের সবশেষ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, যে দুটি ঘটনা ঘটেছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত চলছে। এর পেছনে যারা আছে তাদেরকে আমরা দ্রুতই আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করব। আমি রাজশাহীবাসীকে আহ্বান জানাতে চাই, আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আতক্সিকত হওয়ার কিছু নেই। আপনারা নির্দ্বিধায়-নির্ভয়ে চলাফেরা করুন, পুলিশ সার্বক্ষণিক আপনাদের সুরক্ষায় নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে।

সোনালী/জগদীশ রবিদাস