কমেছে আড্ডা ও অপরাধ প্রবণতা
♦ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নদীপাড়ে শিক্ষার্থীদের বিচরণরোধে পুলিশি অভিযান♦আরোপিত নয়, অভ্যাসগত পরিবর্তন জরুরি; বলছেন পুলিশ কমিশনার
জগদীশ রবিদাস: রাজশাহী শহররক্ষা বাঁধের প্রায় ১২ কিলোমিটার জুড়ে বিনোদনের অন্যতম স্থান হচ্ছে পদ্মা নদীর পাড়। রাজশাহীবাসীর কাছে এটি অন্যতম স্বস্তির একটি স্থান হলেও আরেক দৃষ্টিতে এটিই আবার বৃহৎ অস্বস্তির কারণ! ক্লাস ফাঁকি দিয়ে শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নদীর পাড়ে অবাধ বিচরণের চিত্র দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বেগ বাড়াচ্ছে স্থানীয় সচেতন মহলে।
তবে সম্প্রতি কিছুটা হলেও সে চিত্র যেন পাল্টেছে! নদীকেন্দ্রিক বিনোদনকেন্দ্রে মানুষের উপস্থিতি থাকলেও নগর পুলিশের অভিযানে স্কুল-কলেজ চলাকালীন সময়ে ইউনিফর্ম পড়া শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিম্নমুখী! এর ফলশ্রুতিতে আড্ডাজনিত কারণে দ্বন্দ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে যৌন হয়রানি, প্রযুক্তিগত প্রতারণা ও পরিবারের অগোচরে পালিয়ে যাওয়ার মতো অপরাধের প্রবণতাও বেশ খানিকটা কমে এসেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় থানার একাধিক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
মাঠ পর্যায়ে রাজশাহী মহানগর পুলিশের টানা ২২ দিনের অভিযানে অতিতের চিত্র সাময়িক বদলে গেলেও এটিকে “আরোপিত” পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন আরএমপি’র কমিশনার। তার মতে সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে দরকার “অভ্যাসগত” পরিবর্তন। তিনি মনে করেন, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে এ পরিবর্তনের জন্য শিক্ষক, অভিভাবক, নাগরিক সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পদ্মানদী ঘেঁষা বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষার্থীদের আড্ডার বিষয়টি এ শহরে নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে বড় কুঠি, বড়কুঠি সংলগ্ন গার্ডেন, পাঠানপাড়া এলাকার মুক্তমঞ্চ, সীমান্ত নোঙর, তার খানিক পাশেই সীমান্ত অবকাশ, সিমলা পার্ক, সার্কিট হাউজের রাস্তা, টি-বাঁধ, আই-বাঁধ এলাকাগুলোতেই সবচেয়ে বেশি বিচরণ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের। এর মধ্যে ক্লাস শুরুর সময়কাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওইসব স্থানে ইউনিফর্ম পরে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরই বেশিরভাগ আড্ডায় মেতে উঠতে দেখা যায়।
সকাল ১০টার মধ্যেই শিক্ষার্থীরা এসব স্থানে আসতে শুরু করে। আড্ডা চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এতে করে অতিতে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে পড়ার নজির আছে। এছাড়াও প্রকাশ্যে ধূমপান, ছেলে-মেয়ে হাত ধরে ঘুরাঘুরি, এসব যেন নিত্যদিনের চিত্র হিসেবেই সবার কাছে দৃশ্যমান। এসব নিয়ন্ত্রণে এর আগে মহানগর পুলিশের উদ্যোগে একাধিকবার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও সেসব বেশি দিন চলমান না থাকায় পরিস্থিতির তেমন বড় ধরনের কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি।
এমন অবস্থায় গত ৮ আগস্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে রাজশাহী মহানগর পুলিশের নতুন কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার শিক্ষার্থীদের এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে নতুন পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেন। ওই সভায় তিনি বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিয়ে স্কুল-কলেজের ড্রেস পরে যারা শহরের পদ্মাপাড়ে বসে আড্ডা দেয়, তাদের বিরুদ্ধেও পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এরপর গত ৯ আগস্ট থেকেই মূলত মাঠে নামে মহানগর পুলিশের একাধিক টিম। স্কুল-কলেজ শুরুর সময় থেকে দুপুর পর্যন্ত তারা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে শুরু করেন। অভিযানের শুরুর দিকে ক্লাস চলাকালীন সময়ে প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষার্থীদের নদীর পাড়ের বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়। প্রথম ধাপে কোনরকম কঠোরতা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়ে সতর্ক করতে শুরু করে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, অভিযান চালাতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করে। তারা তাদের ব্যাগে স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম লুকিয়ে আরেকটি পোষাক পরে পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এসময় পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের কাছে থাকা ব্যাগ তল্লাশি করা হয়। পরে প্রথমবারের মতো তাদের সতর্ক করে আবারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরত যাওয়ার পরামর্শ দেয় পুলিশ। এভাবেই গতকাল ৩০ আগস্ট পর্যন্তও পুলিশের এ অভিযান চলমান ছিল।
গতকাল বুধবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত পদ্মাপাড়ের বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, এক মাস আগের সেই চিত্র এখন আর নেই। অন্যান্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ থাকলেও সরাসরি স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পড়ে শিক্ষার্থীদের এসব স্থানে সেভাবে আড্ডা দিতে দেখা যায়নি।
পদ্মা গার্ডেনের এক কফিসপের ওয়েটার জানান, ‘প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন যাবত স্কুল-কলেজ চলাকালীন সময়ে সেভাবে কোন শিক্ষার্থীদের এখানে দেখা যায়নি। তারা আসে, তবে বিকালে বা সন্ধ্যায়। সরাসরি ড্রেস পরে আগের মতো আড্ডা মারার আনাগোনা আর চোখে পড়ে না।’ ফুচকাওয়ালা ফরিদ উদ্দীন বলেন, শুরুর দিকে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীরা আসলেও এখন আর পাওয়া যায়না। হয়তো পুলিশের ভয়ে তারা এই সময়টুকুতে আসে না। কারণ কলেজ চলাকালীন সময়ে পুলিশ এখানে প্রতিদিনই আসে।’
এদিকে, পুলিশের নিয়মিত এই অভিযানের কারণে মহানগরীতে আড্ডাজনিত কারণে দ্বন্দ্ব, শিক্ষার্থীদের মধ্যে যৌনহয়রানি, প্রযুক্তিগত প্রতারণা ও পরিবারের অগোচরে পালিয়ে যাওয়ার মতো অপরাধের প্রবণতাও বেশ খানিকটা কমে এসেছে।
এ বিষয়ে আরএমপি’র বোয়ালিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহরাওয়ার্দী হোসেন বলেন, ‘মাঝেমধ্যেই আমরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার খবর পাই। তারা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়ে এসব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। পুরোটা না হলেও তার কিছু প্রভাব স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দেয়ার মধ্যে দিয়েও গড়ে ওঠে। সেটি এখন নিয়ন্ত্রণে আসার কারণে কয়েকদিন ধরে থানায় শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট অপরাধের প্রবণতা অনেকটাই কমে এসেছে।’
রাজপাড়া, কাশিয়াডাঙা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও এ প্রসঙ্গে একই কথা বলেন। তারা জানান, কিছুটা হলেও থানায় এ ধরনের অপরাধের সংখ্যা এখন কম। রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র জামিরুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের এই বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তারা কোমলমতি। তাদের সঙ্গে কোন প্রকার কঠোরতা ছাড়াই অভিযানগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে। আরএমপির বিভিন্ন থানার একাধিক টিম ও ডিবি পুলিশের সমন্বয়ে এখন পর্যন্ত অভিযান চলমান আছে।’
অপরদিকে, আরোপিত নয়; বরং কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অভ্যাসগত পরিবর্তন আনতে নগরীর সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা কামনা করে মহানগর পুলিশের কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, ‘সাংবাদিকদের তথ্যের ভিত্তিতেই এই অভিযান। আমি যেদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে মতিবিনিময় করি- সেদিন আশ্বস্ত করেছিলাম, বিষয়টি আমরা মোকাবেলা করব।’
কমিশনার বলেন, ‘গত আগস্ট মাসের ৮ তারিখ থেকে কার্যক্রমটি শুরু করা হয়েছে; যা এখনো চলমান। আপনারা এখন যেই পরিবর্তনটি দেখতে পাচ্ছেন, সেটি হচ্ছে ‘আরোপিত’ পরিবর্তন। পুলিশ চাপ দিচ্ছে বলে হচ্ছে। কিন্তু ‘অভ্যাসগত’ পরিবর্তন কিন্তু গড়ে ওঠেনি। আমরা যে কার্যক্রম চালাচ্ছি, সেটি যদি এখন তুলে নেই তবে দেখা যাবে পরিস্থিতি আবার আগের মতোই। আমরা চাই, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অভ্যাসগত পরিবর্তন আসুক। এক্ষেত্রে সকলের করণীয় রয়েছে।’
বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, ‘এক্ষেত্রে বিশেষ করে অভিভাবকদের বেশি করে সচেতন হতে হবে। তাদের ছেলে-মেয়েরা কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, তারা যেন সেই খোঁজ-খবরটি রাখেন। এছাড়াও যারা শিক্ষক রয়েছেন; বা স্কুল ম্যানেজমেন্ট-এর দায়িত্বে আছেন, তারা যদি এই কোমলমতি সন্তানদেরকে বিষয়টি না বোঝান- তাহলে শুধুমাত্র পুলিশের পক্ষে এমন টহল দিয়ে-দিয়ে কার্যকর পরিবর্তন আনা খুবই কঠিন। এক্ষেত্রে আমরা সকলের আন্তরিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।’
সোনালী/জেআর