বামপন্থীদের মধ্যে ঐক্য গড়ার প্রত্যয়
জগদীশ রবিদাস: বিভিন্ন লড়াই-সংগ্রাম, অর্জন ও ত্যাগের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠার গৌরবোজ্জ্বল ৫০ বছর পূর্ণ করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি সদা অবিচল দেশের বৃহত্তর বামপন্থী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে শতাব্দীর অভিযাত্রার প্রাক্কালে দেশের সব বামপন্থী-কমিউনিস্টদের মধ্যে ‘আদর্শগত’ ঐক্যের ডাক দিয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা।
তারা বলেছেন, ‘দেশের কোন বামপন্থী রাজনৈতিক দল ভেঙে গেলে বা বিভক্ত হলে আমরা আনন্দিত হইনা, বরং দুঃখিত হই। কষ্ট পাই! চলমান রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আমাদেরকে বাংলাদেশের বামপন্থী-কমিউনিস্টদের মধ্যে আদর্শগত ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। আমরা যেভাবেই থাকি, শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে শ্রেণি সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য অন্ততপক্ষে গণসংগঠনগুলোর মধ্যে হলেও রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে চাই।’
বুধবার (১৭ মে) সকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউশন মিলনায়তনে ওয়ার্কার্স পার্টির ৫০ বছর পূর্তিতে বছরব্যাপী কর্মসূচির সমাপনী সমাবেশ থেকে তারা এ ঐক্যের ডাক দেন। সারাদেশ থেকে আগত ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বন্ধু সংগঠনের নেতাকর্মীরা এই সমাবেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। ‘নির্বাচন বিদেশিদের নির্দেশে হবে না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, নির্বাচন এলেই দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বিদেশি বন্ধুরা অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। তারা নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরাও অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। তবে নির্বাচন বানচালের কোনো ষড়যন্ত্র হলে তা আমরা প্রতিহত করব। নির্বাচন বিদেশিদের নির্দেশে হবে না, নির্বাচনকে উৎসব হিসেবে নেওয়া দেশের মানুষ নিজেরাই সুষ্ঠু নির্বাচন করবে।’
দেশের বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক বলেন, নির্বাচনের ইতিহাস আমাদের জানা আছে। নির্বাচন নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির লড়াইয়ের ইতিহাসও আছে। সামরিক শাসনামলে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট হয়েছে। দুর্ভাগ্য, সে সময় অনেক কমিউনিস্ট বন্ধুরা ‘হ্যাঁ’ বললেও একমাত্র ওয়ার্কার্স পার্টিই ‘না’ বলেছিল। ’৮৬-তে মিডিয়া ক্যু নির্বাচন হলে ওয়ার্কার্স পার্টি সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নাই। নব্বই পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লড়াইয়েও ওয়ার্কার্স পার্টি ছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেহারা পাল্টে দেওয়া হলো। বিচারপতির বয়স বাড়ানো হলো। এমএ আজিজ কমিশনের সময় ১ কোটির বেশি ভুয়া ভোটার তৈরি করা হয়েছিল। দেশের মানুষ এসব ভুলে যায়নি। ওয়ার্কার্স পার্টি সেই সময় স্পষ্ট উচ্চারণ করে বলেছিল. ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আর না’।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি আরও বলেন, ওয়ার্কার্স পার্টি যেমন নির্বাচনী ব্যবস্থা পাল্টানোর জন্য লড়াই করেছে, নির্বাচনী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তেমনি আগামী দিনেও নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হলে তা প্রতিরোধের লড়াইও করবে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই যখন সাফল্যের মুখ দেখছিল, তখন আসে সেনাশাসন। সেই সেনাশাসন নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছিল আমাদের সামনে। তারা নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলেছিল। আমার যেসব বিদেশি বন্ধু আজ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলেন, তাদের প্রতি আমার জিজ্ঞাসা, সেদিন আপনারা কোন প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন? আপনারা সেদিন দেশে এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন, যাতে সেনাবাহিনী অংশীদার হবে। আপনারা মাইনাস টু থিওরি দিয়েছিলেন। যার মাধ্যমে দুই নেত্রীকে অপসারণ করা হবে এবং সেনার অধীনে কিংস পার্টি গঠন করা হবে। আমরা এগুলো ভুলিনি।
সমাবেশে প্রধান বক্তার বক্তব্য দেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি বলেন, ‘ওয়ার্কার্স পার্টি সবসময় বাস্তবতা বিবেচনা করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আমরা যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গেছিলাম, তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণির হাতে চলে যাচ্ছে। সমস্ত ক্ষমতা মুষ্টিমেয় ধনী ও আমলা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত। এসব মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ব্যর্থতা। জামায়াত-বিএনপির হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে আমরা ১৪ দলীয় জোট গঠন করেছিলাম। সে লক্ষ্য অর্জন হয়ে গেলেও জোটের প্রাসঙ্গিকতা এখনো বিদ্যমান। কারণ, এখনো নির্বাচনসহ অন্যান্য অনেক ইস্যুতে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে; যা আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করতে হবে।’
দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে রাকসুর সাবেক এই ভিপি ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টেরিয়ান বলেন, ‘আপনারা নিজ জেলায়-জেলায় ফিরে গিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করুন। দলকে আরও শক্তিশালী করতে আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। মনে রাখবেন, আমরা কখনোই মানুষের স্বার্থবিরোধী কোন কর্মকাণ্ড করিনি। সুতরাং, আগামীতে আমরাই মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবো। আমরা রাজনৈতিক ইস্যুতেই শুধুমাত্র লড়াই করি তা নয়, কৃষক-শ্রমিক নিয়ে, নদী নিয়ে, পানি নিয়ে, আদিবাসীদের নিয়েও আমরা লড়াই করি। তাই আসুন, আমরা সকলেই মেহনতি মানুষের পক্ষে ওয়ার্কার্স পার্টির চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচি সফলে নিজেদের আত্মনিয়োগ করি।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন, ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ড. সুশান্ত দাস, মাহমুদুল হাসান মানিক, নুর আহমদ বকুল, লুৎফুল্লাহ মুস্তফা। সমাবেশে পলিটব্যুরোর অন্য সদস্যরাও এসময় উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশ সঞ্চালনা করেন ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য কামরূল আহসান। অনুষ্ঠানের শুরুতে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন গণশিল্পী সংস্থা ও গণ সাংস্কৃতিক মৈত্রী’র শিল্পীরা।
সোনালী/জেআর