ঢাকা | মে ১৮, ২০২৪ - ১১:৩৭ পূর্বাহ্ন

পবায় চলছে পুকুরখননের মহোৎসব

  • আপডেট: Monday, April 18, 2022 - 10:43 pm

স্টাফ রিপোর্টার: পবা উপজেলায় আবারো জোরে-শোরে শুরু হয়েছে অপরিকল্পিত পুকুরখনন। তবে পুকুরখনন সিন্ডিকেটের সদস্যরা পরিকল্পিতভাবেই ম্যানেজের মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছে এই খননযজ্ঞ। এসব পুকুরে যাদের ক্ষতি হচ্ছে তাদের আবেদনে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের বিরুদ্ধে।

পবা উপজেলার অনেক মাঠেই তিন ফসলি জমিতে শুরু হয়েছে সংস্কারের নামে মাটি বিক্রির জন্য পুকুরখনন। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি (ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্য) এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নাম ভাঙ্গিয়ে চলছে এই পুকুরখননের মহোৎসব। পুকুরখনন সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম দেখে মনে হচ্ছে পুরো উপজেলা যেন অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভূক্তভোগি বলেন, উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের কৃষি জমির অর্ধেকই এখন অপরিকল্পিত পুকুর। বর্তমানে শুরু হয়েছে পাশের ইউনিয়ন হরিয়ানে। তবে খনন সিন্ডিকেটের সদস্যরা একই। শুধু রূপান্তর হচ্ছে। এদের শক্তি অনেক। অদৃশ্য ম্যানেজের ফলে পুলিশ প্রশাসন, উপজেলা ও জেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ সকলেই নীরব ভূমিকা পালন করছে। খননবন্ধে অভিযোগ দিলেও একটি পুকুর খনন বন্ধ হয়েছে দেখাতে পারবেন না। ফলে পুকুরখননকারিরাই উৎসাহিত হচ্ছে।

কয়েকদিন আগে পুকুরখনন বন্ধে প্রায় সাত দপ্তরে আবেদন করেছেন সোমায়রা আকতার নামের এক ভুক্তভোগি। তিনি আবেদনে উল্লেখ করেন পবা উপজেলার হনিয়ান ইউনিয়নের কাটাখালি থানার কুখন্ডি মৌজায় ২৮৪৪ ও ২৯২২ নং দাগে প্রায় ২০ বিঘা উচু ভিটা জমিতে পুকুরখনন হচ্ছে। আর ইট ভাটাতে মাটি বিক্রির জন্যই এই পুকুর খনন হচ্ছে। খনন করছেন কিসমত কুখন্ডি গ্রামের জোনাব আলীর ছেলে হানিফ মোহাম্মদ পলাশ, কুখন্ডি সোনারপাড়া গ্রামের সেফাতুল্লাহ’র ছেলে ও আওয়ামী লীগ পবা উপজেলা সাবেক সহসভাপতি ফসিউল আলম ভাদু ও কুখন্ডি গ্রামের রফিকুল ইসলাম রফিক।

সোমবার দুপুরে সরোজমিননে দেখা যায়, জোরে-শোরে চলছে খনন কাজ। তিনটি এস্কেভেটর মেশিনে প্রায় ৪০টি টাক্টরে মাটি তুলে দিচ্ছে। সেই মাটি চলে যাচ্ছে আশে-পাশের ১০টি ইটভাটায়। এরমধ্যে নাজাল হোসেনের এমএসবি ও হানিফের ইটভাটা রয়েছে। রাস্তা-ঘাটের বেহাল দশা। এখানকার রাস্তাটি পাকা রাস্তা ছিল ধুলার আস্তরে তা বলার উপায় নেই। ধুলায় বুঝা যাচ্ছে না রাস্তার পাশের বাড়ি-ঘরগুলোতে কোন রঙ ছিল। ওই এলাকার হাসিনা বেগম বলেন, ইটভাটা ও পুকুরখননের ধুলায় দরজা জানালা খুলে রাখার সুযোগ নেই। জামা-কাপড় থেকে শুরু করে খাদ্যদ্রব্যও নষ্ট হচ্ছে।

আবেদনকারি আশংকা করছেন পুকুরখনন সম্পন্ন হলে পুকুরের পাশের জমিগুলো বর্ষার পানিতে ওই পুকুরে ধ্বসে যাবে। এতে তাদের পুকুর বড় হইবে কিন্তু ভুক্তভোগিরা কিছুই পাবে না। এছাড়াও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। ঘরবাড়ি বিনষ্ট হবে এবং বহু ক্ষেত ডুবে ফসলের ক্ষতি হবে। যা আর্থিকভাবে ক্ষতি হতে থাকবে। গতবছরের মত এবারের পারিলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নবীবুর রহমানের ছত্রছায়ায় এসব পুকুরখনন হচ্ছে বলে একটি বিশ্বস্তসুত্রে জানা গেছে।
এদিকে পুকুর খনন বন্ধে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনে আবেদন দিয়েও ফলাফল শূণ্যই থেকে যাচ্ছে। প্রেক্ষিতে একদিকে আবেদনকারিরা পড়ছে বিপাকে এবং অন্যদিকে খননকারিরা হচ্ছে উৎসাহিত। পুকুরখননে জেলায় কমেছে খাদ্য উৎপাদন, হুমকিতে পড়েছে পরিবেশ। গত পাঁচ বছরে বাণিজ্যিক মাছের খামার বেড়েছে বহুগুণ। কমেছে চারণভূমি, সংকট বেড়েছে পশু খাদ্যের। কৃষি জমি কমেছে প্রায় হাজার হেক্টর। বর্ষায় জলাবদ্ধতায় ব্যাহত চাষাবাদ।

শুধু পবা উপজেলার কুখন্ডি ও পারিলাতেই নয়। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নেই চলছে অবৈধ পুকুরখনন। বর্তমানে এই উপজেলায় পুকুরখনন বন্ধে কোন পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। প্রেক্ষিতে পুকুরখনন সিন্ডিকেটের সদস্যরা জোরে-শোরে চালিয়ে যাচ্ছে পুকুরখনন।

জানা গেছে, মৎস্য খামারিরা সাধারণত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জমি বছর মেয়াদি লিজ নিচ্ছেন কাউকে জমি বিক্রি করতে বাধ্যও করছেন। তাছাড়া জলাবদ্ধতার কারণে চাষাবাদ না হওয়ায় চাষিরাও জমি লিজ অথবা বিক্রি করছেন। পুকুর খনন করে পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা রাখছেন না খামারিরা। ফলে বর্ষায় জলাবদ্ধতায় ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। কৃষকরা বলছেন, ফসলি জমি কেটে আসলে পুকুর হচ্ছে না, বরং ঘের হচ্ছে। মাত্র চার থেকে পাঁচ ফুট খনন করা হচ্ছে। কিন্তু পুকুর করতে হলে অন্তত ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর করে খনন করতে হয়। কিন্তু খামারে খনন হচ্ছে মাত্র ৫-৮ ফুট। ক্ষুদ্র চাষিরা অনেক সময় প্রভাবশালীদের ভয়ে, সাময়িক বেশী লাভের আশায় এবং শ্রম থেকে রেহাই পেতে পুকুর খনন করতে দিচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন এই অপরিকল্পিত পুকুর খনন রোধে বরাবরই জেগে জেগে ঘুমাচ্ছেন। যা এ অঞ্চলে ভবিষ্যতে কৃষিতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।

বর্তমানে উপজেলার যে ইউনিয়নেই পুকুরখনন হচ্ছে-তা আওয়ামী লীগ নেতাসহ ইউপি চেয়ারম্যানের ছত্রছায়াই হচ্ছে। রাজশাহী জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুম আল রশীদ সাংবাদিকদের জানান, যথাযথ আইনি পদক্ষেপের অভাবে প্রতিবছর দারুশা এলাকার বড়বিলসহ আশেপাশের বিলে অসংখ্য অবৈধ পুকুর খনন হচ্ছে। ফলে কৃষি জমি, বড়বিলের জীব বৈচিত্র ও রাস্তাঘাট নষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে মিনারুল ও তার ঘনিষ্টরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে সর্বাধিক পুকুর খনন করে থাকে এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ মানুষকে জিম্মি করে জমি নিয়ে পুকুর খননের অনেক অভিযোগ রয়েছে। তারা টাকার বিনিময়ে প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মচারী ও নেতাকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন যাবৎ অবৈধভাবে পুকুর খনন করছে। বেপরোয়া অবৈধ কর্মকান্ড বন্ধে কার্যকর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তিনি। তিনি বলেন, বর্তমানে দারুশা পশ্চিমপাড়া মিনারুল-আব্দুল আজিজের জমির পাশে পুকুর কাটলেও পাড় দেননি। এতে বর্ষায় আব্দুল আজিজের জমি পুকুরে ধ্বসে পড়বে।

এসব অপরিকল্পিত পুকুর খনন ব্যাপারে পবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার লসমী চাকমা বলেন, অবৈধ পুকুর খননের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে জরিমানাও করা হয়েছে। হরিয়ানের ওই পুকুরখনন বন্ধে কাটাখালী থানা পুলিশকে অবহিত করা হয়েছে। তবে বর্তমানে উপজেলা সহকারি কমিশনার ভূমি না থাকার জন্য কিছুটা অসুবিধায় রয়েছি। এরপরেও পুকুরখনন বন্ধে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।