ঢাকা | জুলাই ২৬, ২০২৪ - ৪:৪৪ অপরাহ্ন

দেশে ৭০% তরুণী শরীর নিয়ে কটূক্তির শিকার

  • আপডেট: Saturday, March 5, 2022 - 1:38 pm

অনলাইন ডেস্ক: ১৮ বছরের অনামিকা (আসল নাম নয়) রাজধানীর একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। সে স্থূলতা সমস্যায় ভুগছে। আর এটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলার পথে পদে পদে তাকে কটূক্তি শুনতে হয়। বাসায় মেহমান এলে অস্বস্তিতে পড়ে। ক্লাসে সহপাঠীরাও ‘মোটু’ বলে তার সঙ্গে ঠাট্টা করে। শুধু বাইরে নয়, পরিবারের সদস্যদের মুখেও মাঝে মাঝে শুনতে হয় অপমানজনক কথা। এ অবস্থায় সে মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়েছে। মন খারাপ করে সে প্রায়ই কলেজে যেতে চায় না। করোনায় কলেজ বন্ধ হওয়ায় সে খানিকটা স্বস্তি পেয়েছিল। সম্প্রতি ফেসবুকে একটি ছবি আপলোড করে সরিয়ে নিয়েছে। তার ফ্রেন্ডলিস্টের একজন ‘তুমি আরও ফুলেছ’ বলার পর সে ছবি সরিয়ে ফেলে।

অনামিকার মতো অনেককেই এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। ফ্যাশন মঞ্চ থেকে অন্দরমহল, সেলিব্রিটি থেকে সাধারণ মানুষ- কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। এবার একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, বডি শেমিংয়ের কারণে তরুণীরা কতটা মানসিক বিপর্যয়ের শিকার। ৬৯.৯২ শতাংশ তরুণী শারীরিক অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হচ্ছেন। ৩৭.২৪ শতাংশ তরুণীকে শরীরের আকৃতি, গঠন এবং অবয়ব নিয়ে তাদের আত্মীয়রাই কথায় ও ইঙ্গিতে হেয়প্রতিপন্ন করেছেন। বন্ধু-বান্ধবের কাছে ২২ শতাংশ, পরিবার থেকে ১৪.২৫ শতাংশ, পথচারী থেকে ১১.৮৫ শতাংশ তরুণী বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিনিয়ত হেয়প্রতিপন্ন হলে একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং হীনম্মন্যতা কাজ করে। পরবর্তী সময়ে তা আত্মহত্যার পেছনে অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।

তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপ প্রতিবেদনের ফলাফলে এসব তথ্য উঠে আসে। আজ শনিবার অনলাইনে আয়োজিত ‘তরুণীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এই জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হবে।

চলতি বছরের ১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশের জেলা ও বিভাগীয় শহরে জরিপটি চালানো হয়। জরিপে অংশ নেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী এক হাজার ১৪ তরুণী। তাদের মধ্যে অবিবাহিত ৮৮.১৭ শতাংশ ও বিবাহিত ১০.৯৫ শতাংশ এবং বাকিরা আর সংসার করছেন না।

বডি শেমিংয়ের কারণ খুঁজতে গিয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় এসেছে, ওজনের কারণে ৩৯.৪৯ শতাংশ এবং গায়ের রঙের কারণে ৩৬.৯৫ শতাংশ তরুণীকে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হতে হয়। এ ছাড়া উচ্চতা, মুখাবয়বের গঠন ও দাগ এবং কণ্ঠস্বর প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তরুণীরা বিরূপ মন্তব্য শুনে থাকেন। এ ছাড়া ৪৩.৮৯ শতাংশ তরুণী অনলাইনে বিড়ম্বনার শিকার হন। এর মধ্যে অবান্তর ও কুরুচিপূর্ণ মেসেজ পাঠিয়ে এবং মন্তব্য করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে ৬১.১২ শতাংশকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার ১০.৩৪ শতাংশ, ৯.৮৯ শতাংশ ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল ছবি নিয়ে এবং অযাচিত আইডি স্টকিংয়ের শিকার হন ৫.১৭ শতাংশ।

আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, পারিবারিক টানাপোড়েন ৩১.৮৫ শতাংশ তরুণীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া আর্থিক অসচ্ছলতায় ২৪.৪৬ শতাংশ, বেকারত্বে ১৪.৭৯ শতাংশ, ১৪.৪০ শতাংশ সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার মাধ্যমে ও ২.৩৭ শতাংশ তরুণী যৌন নিপীড়নের কারণে মানসিকভাবে প্রভাবিত হন। বাবা-মা বা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া ২৭.৩২ শতাংশের মনে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। পরিবার থেকে অযাচিত চাপের কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ততার শিকার হয়েছেন ২৩.৯২ শতাংশ তরুণী। ২৩.৭৭ শতাংশ তরুণী নিজেদের অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও পরিবার থেকে বিয়ের চাপের সম্মুখীন হন।

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ৬৫.৫৮ শতাংশ তরুণী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৫.৪৯ শতাংশ বিকৃত যৌন ইচ্ছার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বা কুদৃষ্টির মাধ্যমে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। ২৯.৬২ শতাংশ তরুণীকে আপত্তিকর স্পর্শের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে। আর যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২২.২৬ শতাংশ। ৩৮.৮৬ শতাংশ তরুণী শৈশবে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। তার মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের দ্বারা ৩৫.২৮ শতাংশ। শৈশবে অপরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা ভুক্তভোগী হন ২৮.১৭ শতাংশ। এ ছাড়া ১৬.৫০ শতাংশ প্রতিবেশীদের কাছ থেকে এমন হীন আচরণের শিকার হন। শৈশবের এমন ঘটনা ২৮.৪৩ শতাংশের মনে সবার প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দেয় এবং ২৮.১৭ শতাংশের ভেতর পুরুষবিদ্বেষী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। ১৫.৭৪ শতাংশ একা থাকতে ভয় পান। এ ছাড়া অনেকেই পরবর্তী সময়ে বিয়ে করতে বা শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে ভয় পান বলে জানিয়েছেন। শৈশবের যৌন নির্যাতনের কারণে একজন নারীর সারাজীবন ট্রমার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

সমীক্ষা বলছে, ৪৫.২৭ শতাংশ তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হন। গণপরিবহন হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহূত বাস বা বাসস্ট্যান্ডে যৌন হয়রানির মতো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন ৮৪.১০ শতাংশ তরুণী। এ ছাড়া রেল বা রেলস্টেশনে ৪.৫৮ শতাংশ এবং রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে ১.৫৩ শতাংশ তরুণী যৌন হয়রানির শিকার হন। গণপরিবহনে আপত্তিকর স্পর্শের শিকার ৬৪.৯২ শতাংশ তরুণী। ২০.০৪ শতাংশ কুদৃষ্টির শিকার। তরুণীরা সবচেয়ে বেশি এ ধরনের নিপীড়নের শিকার হন একাকী চলার সময়ে, যা ৭৫.৬০ শতাংশ। তবে ২১.৫৭ শতাংশ মা, বোন, বান্ধবী বা অন্য নারী সঙ্গী থাকা অবস্থায় এবং ২.৮৩ শতাংশ বাবা, স্বামী, ভাই বা অন্য পুরুষ সঙ্গী থাকা অবস্থায় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে সমীক্ষায় উঠে আসে। এ ছাড়া ২২.২৯ শতাংশ তরুণীর মতামতকে পরিবারে মূল্যায়ন করা হয় না। মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়তে হয় ৪৬.২৫ শতাংশকে।

সোনালী/জেআর