ঢাকা | নভেম্বর ২০, ২০২৫ - ১:১১ পূর্বাহ্ন

ঐতিহ্য হারাচ্ছে দু’শ বছরের খরস্রোতা পাগলা নদী

  • আপডেট: Wednesday, November 19, 2025 - 9:55 pm

শিবগঞ্জ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) প্রতিনিধি: তীব্র খরস্রোতার কারণে পাগলা নদী নামে খ্যাত প্রায় দুই শত বছরের পুরানো শিবগঞ্জের নদীটি ঐতিহ্য বিলীনের পথে। এটি ভারতের মালদহ জেলার মহদিপুর এলাকা থেকে শুরু হয়ে উপজেলার শাহাবাজপুর ইউনিয়নের শেষ সীমানা দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার কালিনগর ফাটাপাড়া এলাকায় শেষ হয়েছে। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নয়টি সেতু থাকা ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাগলা নদীর তীরবর্তী এলাকা বেদখল হয়ে নদীর দুই তীরে শত শত বাড়িঘর বা দোকানপাট গড়ে উঠেছে। দুই মাথা দিয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আগের মত নেই নদীর প্রখরতা। হারিয়ে গেছে জলজ উদ্ভিদ ও নানান প্রজাতির মাছ। নেই পালতোলা নৌকা। নদীর পানির স্বচ্ছতা না থাকার পাশাপাশি নেই জেলেদের মাছ ধরার কোন ভিড়।

পাগলা নদীর তীরবর্তী এলাকা ঘুরে বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পাগলা নদীর জৌলুস হারানো বিভিন্ন কারণ। শ্যামপুর ইউনিয়নের বাজিতপুর গ্রামের ৭০ বছর বয়সী জয়নাল আবেদীন, জেলে আব্দুর রাজ্জাক, কফিল উদ্দিন, আলাউদ্দিন ও জামাল উদ্দিন বলেন, আগে পাগলা নদীতে ফুয়াড়ী জাল, টাকজাল, ছিপ, চোঙ্গা, ডালি, দহি ও হোচ্চা প্রভৃতি দিয়ে পিয়ালী, বায়াম, গুচি, সোল, গজার, চিংড়ি, বেলে, চাং ইত্যাদি মাছ শিকার করেছি। তখন নদীতে প্রচুর দল বা শৈবাল (জলজ উদ্ভিদ) থাকতো। সেই শৈবাল বা দলের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদন হতো। কালের প্রবাহে দল বা শৈবাল বিলুপ্তির সাথে সাথে হারিয়ে গেছে দেশি প্রজাতির সুস্বাদু মাছ। বর্তমানে আষাঢ় মাসেও এ নদীতে পানি থাকে না। পানি না থাকায় এক সময়ের খরস্রোতা নদী তীরবর্তী জনসাধারণ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যাহত হয় চাষাবাদ। একদিকে পদ্মা নদীর ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ করায় পদ্মা নদীর সাথে পাগলা নদীর সংযোগ বন্ধ করে দেয়ায় বন্যার সময় পদ্মা নদীর পানি পাগলা নদীতে প্রবেশ করতে পারে না।

তারা আরও বলেন, শাহবাজপুর ইউনিয়নের শেষ সীমান্তে ভারত সরকার ভারত থেকে বয়ে আসা পাগলা নদীর মুখে বিশেষ কায়দায় পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ার কারণে সেদিক থেকেও পানি ও মাছ আসা বন্ধ হয়ে গেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, পাগলা নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্তের অন্যতম কারণ হলো লাইলন সুতা দিয়ে আড়কি জাল, ক্যাপা জাল, রিং জাল, ভুত জাল, টাকজাল ও ফুয়ারি জাল করা তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের জাল দিয়ে মাছ শিকার করায় মাছের পোনা পর্যন্ত জালে ধরা পড়া। ২০২১ সালে অপরিকল্পিতভাবে পাগলা নদী খননে নদীর শৈবাল বা দলের বিলুপ্তি ঘটায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। পাশাপাশি হারিয়ে গেছে নদীর ঐতিহ্য। শ্যামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম বলেন, নদী খননের কারণে শৈবাল বা দল মাটির নিচে চাপা পড়ায় আর বাড়েনি। এদিকে ক্যারেন্ট সুতা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের জালে মাছ ধরায় মাছের উৎপাদন দিন দিন কমে গেছে। তিনি পাগলা নদীর ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার সরকার বলেন, নদীতে ক্যারন্ট জালে মাছ শিকার বন্ধে ও নদীর তীর দখলমুক্ত করতে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। বেদখল তীর অনেকটা দখলমুক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম আহসান হাবীব বলেন, শিবগঞ্জ উপজেলার শাহাবাজপুর ইউনিয়নের শেষ সীমানা হতে সদর উপজেলার কালিনগর ফাটাপাড়া পর্যন্ত পাগলা নদীকে জীবন্ত রাখা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। নদীর সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্ত করতে জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে ২০১৯ সালে অভিযান চালিয়ে নদীর জমি কিছুটা দখলমুক্ত হয়েছে। নদী খনন করা হয়েছে ২০২১ সালে।

বর্তমানে নদীটি আর মৃত্যু নয়। পদ্মা নদীর সাথে সংযোগের বিষয়টি বিবেচনাধীন। কারণ এখানে নদী ভাঙন ঠেকাতে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। পাগলা নদীতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারলে জন্ম নেবে শৈবাল বা দল। ফিরে আসবে পুরাতন ঐতিহ্য। তিনি আরও বলেন, নদীতে বাঁধ, সেতু বা খাল ভরাটের কারণে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিলুপ্তি হয়েছে শৈবাল বা জলজউদ্ভিদ। পাগলা নদীর বিষয়ে পরিকল্পনা প্রস্তুতে একটি কমিটি করা হয়েছে। যাচাই বাছাই করে পরিকল্পনাটি যদি ৫০ কোটির নিচে হয়, তাহলে সেটি ঢাকায় পাঠানো হবে। অনুমোদন পেলে পাগলা নদীর ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা হবে।