ঢাকা | নভেম্বর ১৯, ২০২৫ - ১:৩২ পূর্বাহ্ন

শতবর্ষের ঐতিহ্য: নবান্নের উচ্ছ্বাসে পাঁচশিরা মাছমেলা

  • আপডেট: Tuesday, November 18, 2025 - 9:40 pm

কালাই (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি: অগ্রহায়ণের প্রথম প্রহর। ভোরের কুয়াশা তখনও চারদিক ঢেকে রেখেছে। সেই কুয়াশা ভেদ করে পূর্বের আকাশে ধীরে ধীরে উঁকি দিচ্ছে সোনালি রোদ। হিমেল সকাল উপেক্ষা করে মানুষের ঢল নেমেছে জয়পুরহাটের কালাইয়ের ঐতিহ্যবাহী পাঁচশিরা বাজারে। কারণ নবান্ন উৎসব। আর এই উৎসব ঘিরেই বসে পাঁচশিরার শতবর্ষী মাছের মেলা, যার অপেক্ষায় থাকে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও।

গ্রামবাংলার কৃষকরা নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দে পুঁথিগত পঞ্জিকা অনুযায়ী অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে নবান্ন উদযাপন করেন। নতুন চালের পায়েস, পিঠা-পুলি, ক্ষীর, মুড়ি আর খইয়ের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে বাড়ি থেকে বাড়িতে। সেই উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতেই ১০৫ বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে কালাই পৌরশহরের পাঁচশিরা বাজারে বসেছে এই মাছ মেলা। গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৪টা থেকেই মেলায় জমে ওঠে মানুষের ভিড়। রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, চিতল, বাঘাইরসহ নানা দেশি প্রজাতির মাছ দেখতে, কিনতে আর দরদাম করতে মানুষের ঢল নামে। এতে ওঠে উৎসবের আমেজ।

জানা গেছে, পাঁচশিরা মাছ মেলার ইতিহাস শতাব্দিরও বেশি সময়ের। এলাকার প্রবীণদের মতে, নতুন ধানের ভাত রান্নার দিন থেকেই এর সূচনা। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের আগেভাগেই জানানো হয় নিমন্ত্রণ ঘরে ফিরে নবান্নের আনন্দ ভাগ করে নেয়ার। সেই আনন্দ ঘিরেই মাছ ব্যবসায়ীরা সপ্তাহখানেক আগে থেকেই তৈরি হতে শুরু করেন। বড় বড় মাছ সংগ্রহ করেন, আড়তে তোলেন আর আশপাশের এলাকায় মাইকিং করে মেলার আগমনী বার্তা ছড়িয়ে দেন। এ বছরও মেলায় নজর কেড়েছে বেশ কিছু বিশাল আকৃতির মাছ। ৩৫ কেজির একটি সিলভার কার্প বিক্রি হয়েছে ৪২ হাজার টাকায়। ১৯ কেজির কাতলা মাছ ২৫ হাজার টাকায়। তিন কেজি থেকে শুরু করে ৩০-৩৫ কেজিরও বেশি ওজনের মাছের সমাগমে মেলায়।

ব্যবসায়ীদের ভাষায়, যদিও ক্রেতা কিছুটা কম, তবু মানুষের উচ্ছ্বাসে তার প্রভাব পড়েনি। বড় আকারের মাছের কেজিপ্রতি দাম ছিল ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকা। আর বাঘাইর ও চিতল উঠেছে ১৩০০ থেকে ২০০০ টাকার ঘরে। মাঝারি মাছ বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে। মেলার সবচেয়ে আনন্দঘন দিক হচ্ছে জামাইদের আগমন। শ্বশুরবাড়ির দাওয়াতে এসে তারা এক নীরব প্রতিযোগিতায় অংশ নেন-কার জামাই কত বড় মাছ নিয়ে ফিরতে পারেন। বগুড়ার শিবগঞ্জ থেকে আসা মিজানুর রহমান ১২ কেজির কাতলা কিনে জানালেন, নবান্নে মাছ কেনা বাধ্যতামূলকই বটে। তাই দাম বেশি হলেও আপত্তি নেই। মূলগ্রাম মহল্লার সতেন চন্দ্র বর্মণ প্রায় ৪৪ হাজার টাকায় দুটি বড় মাছ কিনে খুশির হাসিতে বললেন, নাতি-নাতনিদের মুখের হাসিই তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

শিক্ষক নারায়ণ বাবু বলেন, এই মেলা শুধু কেনাবেচার কেন্দ্র নয়, মানুষের মিলনমেলাও। পুরো উপজেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক ধরনের উৎসবের রং। ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম ও উজ্জ্বল চন্দ্র বর্মণ জানান, এ বছর মাছের দাম ছিল স্বাভাবিক এবং বিক্রিও হয়েছে বেশ ভালো। অনেকে ১৫ থেকে ২০ মণ পর্যন্ত মাছ বিক্রি করতে পেরেছে। মাঠ থেকে নতুন ধান ঘরে তোলা কৃষকদের কাছে নবান্ন মানে নতুন সূচনা। সেই আনন্দকে কেন্দ্র করেই পরিবারের সব সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, জামাই-বিয়ানদের নিয়ে চলে উৎসবমুখর আয়োজন।

বাইগুনী গ্রামের আমজাদ হোসেন জানান, আত্মীয়-স্বজনদের আপ্যায়নের জন্য তিনি প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার টাকার মাছ কিনে থাকেন। স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল মিয়া ৯ কেজির একটি বড় কাতলা কিনে জানান, পরিবারের আনন্দের জন্য কষ্ট হলেও তা সার্থক মনে করছি। মেলার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় নজরদারি রেখেছে মৎস্য বিভাগ। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মৌমীতা মুহাইমিন বলেন, বড় বড় মাছ দেখে স্থানীয় চাষিরা উৎসাহিত হচ্ছেন। মেলায় কেবল একদিনেই অন্তত এক কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয়। নষ্ট বা বিষাক্ত মাছ বিক্রি ঠেকাতে রয়েছে কঠোর তদারকি। কালাই পৌরসভার প্রশাসক শামিমা আক্তার জাহান বলেন, নবান্নকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক বাড়িতে চলে আনন্দ-উৎসব। আগামীতে মেলার পরিধি আরও বাড়ানোর প্রত্যাশাও রয়েছে।