ঢাকা | নভেম্বর ১৯, ২০২৫ - ১:৪৯ পূর্বাহ্ন

বিনা পুঁজির ফসল কাশে রক্তাক্ত পদ্মার চর

  • আপডেট: Tuesday, November 18, 2025 - 11:00 pm

স্টাফ রিপোর্টার: পাবনা, কুষ্টিয়া, নাটোর ও রাজশাহী পদ্মা নদীর চরে কাশের খড় ও বালুমহালের বাণিজ্য হয় বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার। এসব নিয়ন্ত্রণ করে একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী। সম্প্রতি কাশের খড়কে কেন্দ্র করে পদ্মার চরে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে।

আর অভিযোগ উঠেছে কাঁকন বাহিনীর বিরুদ্ধে। নদীর বুকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া ও কথায় কথায় গুলি চালানো এই বাহিনীর ভয়ে তটস্থ চার জেলার চরাঞ্চলের মানুষ। নিরাপত্তার ভয় আর শঙ্কায় ব্যাহত হচ্ছে চরের চাষাবাদ।

পদ্মার বুকে জেগেছে বির্স্তীণ চর। বিনা পঁজির ফসল কাশ। ব্যবসায়ীদের দাবি, শুধুমাত্র বাঘার উপজেলার চরেই বছরে কাশের খড়ের ব্যবসা হয় অন্তত ৫০ কোটি টাকার। পাবনা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত হয় ৩শ কোটির বাণিজ্য। পদ্মার চরে বালুর ওপরে জন্মানো কাশবন থেকে পাওয়া খড়ের বেশিরভাগ পানচাষিদের পানের বরজে ছাউনি তৈরিতে কাজে লাগে। রাজশাহী জেলার পবা, মোহনপুর, দুর্গাপুর ও বাগমারা এলাকার পানের বরজে এই খড়ের বেশ চাহিদা।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলার ৯টি উপজেলায় ৪ হাজার ৫০৯ হেক্টর জমিতে পানের চাষ হচ্ছে। এর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৯ হাজার ৬৮১ টন। এই পানচাষ পুরোটাই খড় নির্ভর। এই সব উপজেলার পান চাষিদের কাছে একমাত্র ভরসা পদ্মার চর থেকে পাওয়া খড়। পদ্মার পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর খড় কাটা শুরু হয়। পরে সেগুলো পদ্মার ঘাটে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে এক হাজার খড় বিক্রি হচ্ছে ২২ হাজার টাকা দরে। অর্থাৎ এক আঁটি খড়ের দাম ২২ টাকা। মাত্র দুই মাস চলা এই ব্যবসার শেষের দিকে প্রতি আঁটি খড়ের দাম পৌঁছায় ৩০ থেকে ৩২ টাকা পর্যন্ত।

চর যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের কাছ থেকে কাশের খড় কেনেন। বিশাল অংকের এই কারবারে জমির মালিক থাকে উপেক্ষিত। বর্তমানে পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করছে কাঁকন বাহিনীসহ প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এই কাশবন দখলকে কেন্দ্র করে গত ২৭ অক্টোবর কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের পদ্মার চরে আমান ও নাজমুল নামে দু’জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে কাঁকন বাহিনীর বিরুদ্ধে। এতে মারা যায় বাহিনীর সদস্য লিটনও। ভুক্তভোগীরা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বাহিনীর প্রধান কাঁকন পলাতক। দৌরাত্ম কিছুটা কমেছে। তারপরও হুমকি ধামকিতে আতঙ্কিত পুরো এলাকার মানুষ। চাষাবাদের জন্য মানুষ চরে যেতে পারছে না।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সিসিটিভি ফুটেজে প্রমান মিলেছে, স্পিডবোট ও বড় নৌকায় করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে চলতো নিয়মিত সশস্ত্র মহড়া। ভারি ভারি অস্ত্র নিয়ে ছুড়তো গুলি, চলতো দখলদারি। চরের কাশবন, ভূমি দখল, বালু মহল নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারে কাঁকন বাহিনীর এই দৌরাত্ম পাবনার সাড়া ইউনিয়নের বালুর ঘাট থেকে শুরু করে, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, দৌলতপুর ও নাটোরের লালপুর হয়ে রাজশাহী বাঘার আলাইপুর ঘাট পর্যন্ত। স্থানীয়দের ভাষ্য, বিভিন্ন সময় চার জেলা জুড়ে বিস্তৃত পদ্মার দুর্গম চরাঞ্চলে নামে-বেনামে বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীর উত্থান ঘটেছে। সব বাহিনী আধিপত্য বিস্তার করেছে বালু আর চরের ফসল দখলকে কেন্দ্র করে। সন্ত্রাসীদের ভাগ না দিয়ে কেউ চরের ফসল ঘরে তুলতে পারতেন না।

এ নিয়ে দ্বন্দ্বে বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে ৪১ জন মানুষ খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব সন্ত্রাসী বাহিনীর অন্যতম আলোচিত ছিল ‘পান্না বাহিনী’ ও ‘লালচাঁন বাহিনী’। পান্নার ওস্তাদ ছিলেন বর্তমানের প্রভাবশালী সন্ত্রাসী বাহিনী প্রধান কাঁকন। আমান ও নাজমুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হাসানুজ্জামান কাঁকনকে প্রধান আসামি করে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানায় মামলা হয়েছে। গত জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এ বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ছয়টি। দুর্গম চরে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান চলছে। নৌপুলিশও বাড়িয়েছে তৎপরতা।

কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ বলেন, চর এলাকায় গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে। অপরাধীরা গ্রেপ্তার হয়েছে। অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। কাঁকন বাহিনীকে ধরতে চরে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। গত ১৭ জুলাই নাটোরের বালুমহালে কাঁকন বাহিনীর আস্তানায় অভিযান চালিয়ে ৩টি পিস্তল, ৪৮টি গুলি, মানুষের মাথার খুলি, মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে যৌথবাহিনী।

কাশ দিয়ে বরজ তৈরি করা হয়। এর জন্য সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে খড়। এগুলো দিয়ে ছাউনি না দিলে পান চাষ করা সম্ভব না। খড় দিয়ে পান বরজের চালা ও চারপাশ ঘিরে দেয়া হয়। এর ফলে রৌদ বা কুয়াশায় পানের পাতা নষ্ট হয় না। এমনভাবে সারাবছর রাখতে হয়। এই খড়গুলো পদ্মার শ্যামপুর ঘাট ছাড়াও বাঘা উপজেলার পদ্মা নদীর বিভিন্ন ঘাট থেকে কিনে নিয়ে আসা হয়। মূলত এই সব উপজেলার পানচাষিদের একমাত্র ভরসা পদ্মার খড়। অন্য উপায়ে করতে গেলে দ্বিগুণ খরচ হবে। তাই খড় দিয়েই করা হয় পানের বরজ।

রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও কুষ্টিয়ার পদ্মার চরগুলোতে কাঁকন বাহিনীসহ ১১টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আধিপত্য দীর্ঘদিনের। তারা চরের বাসিন্দাদের ওপর অত্যাচার করে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে- মন্ডল বাহিনী, টুকু বাহিনী, সাঈদ বাহিনী, লালচাঁদ বাহিনী, রাখি বাহিনী, শরীফ কাইগি বাহিনী, রাজ্জাক বাহিনী, চল্লিশ বাহিনী, বাহান্ন বাহিনী, সুখচাঁদ বাহিনী ও নাহারুল বাহিনী। এই খড় ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দখল ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে গেল ২৭ অক্টোবর কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের হবিরচরে কাঁকন বাহিনীর গোলাগুলিতে বাঘা উপজেলার নিচখানপুরের আমান মন্ডল ও নাজমুল মন্ডল নিহত হন। পরের দিন ২৮ অক্টোবর হবিরচর থেকে লিটন নামের এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, নিহত লিটন কাঁকন বাহিনীর সদস্য। এই হত্যকাণ্ডের পরে মূলত আলোচনায় আসে চরের বিভিন্ন বাহিনীর সক্রিয়তার কথা। এ নিয়ে ভয় ও আতঙ্কে মুখ খুলেতে চায় না চার জেলার চরাঞ্চলের মানুষ।

চারবাসী জানান, বিভিন্ন সময় স্পিডবোট ও বড় নৌকায় করে পদ্মার বুকে চলে সশস্ত্র মহড়া। ভারি ভারি অস্ত্র নিয়ে গুলি ছোড়া হয়। চরের কাশবন, ভূমি দখল, বালু মহল নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারে বাহিনীগুলোর দৌরাত্ম পাবনার সাড়া ইউনিয়নের বালুর ঘাট থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, দৌলতপুর, নাটোরের লালপুর হয়ে রাজশাহী বাঘার আলাইপুর ঘাট পর্যন্ত। প্রতি বছর ভরা মৌসুমে পানি নেমে যাওয়ার পর পদ্মার বুকে জেগে ওঠে বিস্তীর্ণ চর। এই চরের বিনা খরচের ফসল কাশ বা খড়। নাম প্রকাশ না করা অনুরোধে ব্যবসায়ীদের দাবি, শুধুমাত্র বাঘার উপজেলার চরেই বছরে কাশের খড়ের ব্যবসা হয় অন্তত ৫০ কোটি টাকার। পাবনা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত হয় ৩শ কোটি টাকার বাণিজ্য। বিশাল অংকের এই কারবারে জমির মালিক থাকে উপেক্ষিত। পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করে কাকঁনসহ বিভিন্ন বাহিনী ও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট।

বাঘার নিচ চকরাজাপুর চরের বাসিন্দা রজব মন্ডলের সাড়ে ১২ বিঘা জমি রয়েছে। তিনি বলেন, চরের অন্য ফসলগুলো মোটামুটি পাওয়া যায়। তবে সেখানেও ভয় আছে। চরের জমিতে জন্মানো খড়গুলো জমির মালিকরা পায় না। এই খড়গুলো দখল করে বিক্রি করে বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন। খড় বিক্রি করতে নিষেধ বা টাকা দাবি করলে বাহিনীর লোকজন মারধর করে। তাদের ভয়ে কেউ মুখ খোলে না। আরেক জমির মালিক বাচ্চু বলেন, কোনো কোনো জমির মালিককে বাহিনীর লোকজন খুব অল্প টাকা দেয়। দেখা যাচ্ছে ২০ হাজার টাকার খড় হলে তারা জমির মালিকে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা দেয়। তবে বেশিরভাগ জমির মালিক জানের ভয়ে জমিতে যায় না। এছাড়া কেউ গোপনে খড় বিক্রি করে দিলে বাহিনীর লোকজন নদীতে নৌকা আটকে চাঁদাবাজি করে। এ কারণে বাইরের খড় ক্রেতারারা জমির মালিকের থেকে খড় কিনতে আগ্রহী না।

তারাও বাহিনীর লোকজনদের চেনে। তাদের থেকে খড় কেনে। খড় কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে চরে কোটি টাকা লেনদেন হয়। তাই প্রতিবছরই রক্ত ঝরে পদ্মার চরে। নীচ খানপুর গ্রামের বাসিন্দা মিঠু সরদার। তিনি গেল ২৭ অক্টোবর গোলাগুলির ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, সেখানে খড় কাটা হচ্ছিল। এক সঙ্গে কয়েকজন ছিলাম। হঠাৎ করে কাঁকন বাহিনী স্পিডবোট থেকেই অতর্কিত গুলি করতে শুরু করে। ওরা গুলি করছে, আমরা গুলির ভয়ে শুয়ে ছিলাম। তারা আটজন ছিল, কিছু না হলেও দুই ঘণ্টা গুলি করেছে। মিঠু বলেন, প্রথমে আমানের মাথায় গুলি লাগে। তাকে দেখে নাজমুল চিৎকার দিয়ে উঠে। এসময় আমানকে ধরতে গিয়ে নাজমুলেরও গুলি লাগে। তাদের আটজনের হাতে অস্ত্র ছিল। আমরা তো সাধারণ লোক। আমরা মাঠ দেখতে গিয়েছি। এই মাঠে দেড়শ বিঘা জমি আছে। সেই জমির খড় জোর করে নিয়ে নেয় কাঁকন বাহিনীর লোকজনেরা।

বাঘা উপজেলা কৃষি অফিসার শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, কুষ্টিয়ার কাছাকাছি হবিরচরে আমাদের প্রায় ১ হাজার বিঘা জমিতে ফসল ফলে। এই চরে আগে শুধু বাদাম হতো। বর্তমানে সেখানে ধান, গম, ভুট্টা, বাদামসহ ডাল জাতীয় ফসল ফলে। কোনো কোনো চরে চাষাবাদ হয় না, শুধু পড়ে থাকে।

গত ৮ নভেম্বর রাত থেকে রোববার ৯ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত পুলিশ, র‌্যাব ও এপিবিএনের প্রায় ১ হাজার ২০০ জন সদস্য কুষ্টিয়া, পাবনা, নাটোর ও রাজশাহী পদ্মার চরে ‘অপারেশন ফাস্ট লাইট’ অভিযান পরিচালনা করে। এসময় ৬৭ জনকে অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে রাজশাহী জেলার পদ্মার চর থেকে ১৪ জন, নাটোর থেকে ২০ জন, পাবনা থেকে ২৪ জন এবং কুষ্টিয়া থেকে ৯ জন রয়েছে।

ওইদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজির কনফারেন্স রুমে সংবাদ সম্মেলনে রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহান বলেছেন, অভিযানে মোট ৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসময় ১০টি অস্ত্র, চার রাউন্ড গুলি, দুইটি গুলির খোসা, ২৪টি হাসুয়া, ৬টি ডেসার, ২টি ছোরা, ৪টি চাকু, ৩টি রামদা, ২টি চাইনিজ কুড়াল, ২০ বোতল ফেসনিডিল, ৫০ পিস ইয়াবা, ৮০০ গ্রাম গাঁজা, ৫টি মোটরসাইকেল ও একটি লোহার পাইপ উদ্ধার করা হয়েছে। চরাঞ্চলে শান্তি ফেরাতে এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে।

বাঘা উপজেলার চকরাজাপু ইউনিয়নের ৮ নম্বর মেম্বার তন্চু মোল্লা বলেন, চরের খড়ের টাকা জমির মালিক পায় না। সব খড় বিভিন্ন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকে। এখনও আছে। এক বিঘা জমিতে দুই থেকে তিন হাজার খড় হয়। ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা দরে কেনাবেচা হয়। চরের কাশি এখনও বিভিন্ন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। প্রতিবছর খড় ও চরের জমি দখলকে কেন্দ্র করে রক্ত ঝরে। এই বছরও রক্ত ঝরেছে।