ঢাকা | নভেম্বর ১৪, ২০২৫ - ১:৩৬ পূর্বাহ্ন

উত্তরাঞ্চলজুড়ে খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত গাছিরা

  • আপডেট: Thursday, November 13, 2025 - 9:16 pm

স্টাফ রিপোর্টার: শীত এখনো পুরোপুরি না নামলেও খেজুরের রস ও গুড় তৈরির প্রস্তুতি শুরু করেছেন উত্তরাঞ্চলের গাছিরা। আর কদিন পর শুরু হবে রস সংগ্রহ, তাই গাছিদেরও ব্যস্ততা বেড়েছে। আগামী ৪-৫ মাস চলবে রস সংগ্রহের এই কর্মযজ্ঞ, যা থেকে তৈরি হয় সুমিষ্ট পাটালি ও লালি গুড়।

প্রতিবছর অক্টোবরের শেষ দিকে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলাসহ রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট ও পুঠিয়া উপজেলায় শুরু হয় খেজুরের রস আহরণ ও গুড় তৈরির মৌসুম। রস সংগ্রহের জন্য গাছ প্রস্তুত করে পাতা হয় মাটির হাঁড়ি। সারা রাত ধরে ফোঁটা ফোঁটা রস জমে হাঁড়িতে। সকালে সেই রস নিয়ে শুরু হয় গুড় তৈরির ব্যস্ততা। বড় চুলায় ফুটন্ত রসের ঘ্রাণে তখন মিষ্টি হয়ে ওঠে পুরো গ্রাম।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় খেজুরগাছের সংখ্যা ১১ লাখ ৮ হাজার ১৮টি। প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ২৫ লিটার রস পাওয়া যায়, যা থেকে প্রায় ১০ কেজি গুড় তৈরি হয়। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে রস সংগ্রহ মৌসুম। গত বছর রাজশাহীতে প্রায় ১০ হাজার টন গুড় উৎপাদিত হয়েছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার গাছির আয় হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। চলতি মৌসুমে আরও বেশি গুড় উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।

চারঘাট উপজেলার চকগোচর গ্রামের গাছি ওবায়দুল বলেন, গ্রামের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। চিনির দাম কম হওয়ায় অনেকে আবার রসের সঙ্গে চিনিও মিশিয়ে দিচ্ছেন। এতে লাভ বেশি হচ্ছে। তবে যাঁরা চিনি দিয়ে গুড় তৈরি করেন না, তাঁদের গুড়ের দাম কিছুটা বেশি। এখন অনলাইনে খাঁটি গুড়ের ভালো চাহিদা আছে। রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, রাজশাহীর খেজুর গুড়ের সুনাম সারা দেশে। গেল মৌসুমে প্রায় ২০০ কোটি টাকার গুড় বিক্রি হয়েছে। এবার আরও বেশি উৎপাদন হবে বলে আশা করছি। তবে কিছু অসাধু গাছি গুড়ের সঙ্গে চিনি মেশাচ্ছেন, যা রাজশাহীর খাঁটি গুড়ের সুনামের জন্য হুমকি।

এদিকে, নওগাঁর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় জমির আইল, রাস্তার পাশ এবং পুকুরপাড়ে বছরজুড়ে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা খেজুর গাছগুলোর কদর এখন বেড়েছে। কারণ এই গাছগুলো শীত মৌসুমজুড়ে আহরিত সুমিষ্ট রস দেবে। তাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছিরা দা হাতে, কোমরে রশি বেঁধে নিপুণ হাতে এক গাছ থেকে অন্য গাছে ডাল কেটে পরিষ্কার করতে ছুটছেন। এরই মধ্যে অনেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছে ‘নলি’ গাঁথা শুরু করেছেন। গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে খেজুরের গাছ ‘তোলা’ (গাছের উপরিভাগ চেঁছে পরিষ্কার করা) হয়। কয়েক দিন রেখে গাছের তোলা অংশ শুকানো হয়।

এরপর খেজুরগাছ চেঁছে ওপরের দিকে দুটি ‘চোখ’ কাটা হয়। নিচের দিকে বসানো হয় নলি। পরে সেখান থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। শীত মৌসুমে ৪-৫ মাস খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যায়। যত বেশি শীত পড়ে, গাছ থেকে তত বেশি রস পাওয়া যায়। তবে গ্রামের মাঠে আর মেঠোপথের ধারে কিছু গাছ থাকলেও বিভিন্ন কারণে দিনে দিনে খেজুর গাছের সংখ্যা কমছে বলে জানান তারা। আত্রাই উপজেলার সাহাগোলা এলাকায় নাটোরের লালপুর থেকে এসেছেন গাছি সোহেল রানা। তিনি ২৫ বছর ধরে খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করেন।

তিনি বলেন, এ বছরও ৭০টির বেশি খেজুরের গাছ তোলার (পরিচর্যার) কাজ শুরু করেছি। আমি গুড় তৈরি করি। শীত মৌসুমে ভালো আয় হয়। খেজুরের গাছ কেটেই বছরের ৬ মাস সংসার চালাই। এখন নতুন গাছি আর পাওয়া যায় না। কেউ এসব কাজে আসতে চান না। খেজুর গাছও কমছে, গাছিও হারিয়ে যাচ্ছে। সদর উপজেলার দিঘিরপাড় গ্রামের গাছি আকামত আলী বলেন, আমি আগে প্রায় ১০০ গাছ কাটতাম। এখন সেটি এসে দাঁড়িয়েছে ৩০-৪০টিতে। শীতের শুরুতে রস কম পাওয়া যায়। যত বেশি শীত পড়ে, গাছ থেকে তত বেশি রস পাওয়া যায়। কাঁচা রস বিক্রির পাশাপাশি পাটালি ও লালি গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করি। তবে বর্তমানে যে হারে খেজুর গাছ হারিয়ে যেতে বসেছে, হয়তো এক সময় আমাদের এলাকায় খেজুর গাছ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

অপরদিকে, শীতের আগমনী বাতাস যখন ধীরে ধীরে গ্রামীণ বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন সিরাজগঞ্জের গাছিরাও নিজেদের ব্যস্ততা শুরু করেছেন নতুন মৌসুমের জন্য। কাজিপুর, রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও শাহজাদপুরের গ্রামে খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য গাছ প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। গাছিরা জানাচ্ছেন, খেজুর রস সংগ্রহের জন্য প্রথমেই গাছের মাথা পরিষ্কার করতে হয়। সাদা অংশ কেটে রোদে শুকানো হয়। পরবর্তীতে আবার তা কেটে নলিতে ছোট-বড় বাসন বেঁধে রস সংগ্রহ করা হয়।

তাড়াশ উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের রানীদিঘী গ্রামের হাছেন আলী বলেন, শীতের আগমনের জন্য এবার একটু আগেই গাছ প্রস্তুত করছি। একটি গাছকে ডাল পালা কেটে প্রস্তুত করতে কয়েক দিন সময় লাগে। গাছিদের ব্যবহারিক দক্ষতা অবাক করে দেয়। সাধারণত মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয়, যার ধারণক্ষমতা থাকে ৬ থেকে ১০ লিটার। ভালো রাখার জন্য হাড়ির ভিতরে চুনের প্রলেপ দেয়া হয়, তবে কাঁচা রস খাওয়ার গাছের হাড়িতে চুন দেয়া হয় না।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শর্মিষ্ঠা সেন গুপ্ত জানান, উপজেলায় বিভিন্ন এলাকায় খেজুর গাছ রয়েছে। খেজুর গাছের জন্য বাড়তি কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। কৃষি বিভাগ কৃষকদের বাড়ির আশপাশ, জমির আইল, পুকুরপাড় এবং সড়কের ধারে খেজুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। পরিত্যক্ত জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খেজুর বাগান গড়ে তোলা হলে কৃষকেরা গুড় উৎপাদন করে আরও বেশি লাভবান হবে বলে তিনি জানান।