ঢাকা | সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৫ - ৩:০৪ পূর্বাহ্ন

গোমস্তাপুরে চার দশক পর ফিরল ওঁরাও সম্প্রদায়ের কারাম উৎসব

  • আপডেট: Saturday, September 20, 2025 - 11:17 pm

স্টাফ রিপোর্টার: প্রায় ৪০ বছর পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার পার্বতীপুর ইউনিয়নের শেরপুর কোঠাডাঙ্গা গ্রামে শুরু হয়েছে ওঁরাও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব বা ডালপূজা। গ্রামের নারীদের উদ্যোগে আবার চালু হওয়া এ উৎসব ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে সম্প্রীতি, আনন্দ আর নাচ-গানের আবহ। আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে পুঁতে রাখা কারামগাছের ডাল। এর চারপাশে ভিড় জমিয়েছেন নারী-পুরুষ ও শিশুরা। কিশোরীরা দূর্বাঘাস ও ফুল দিয়ে কারাম ডালগুলো সাজাচ্ছে।

নারীদের কেউ কেউ উপোস ভেঙে সেজেগুজে এসেছেন। সবার চোখেই উচ্ছ্বাস। বাঁশি, মাদল ও ঢোলের তালে শুরু হলো নাচ-গান। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নাচে-গানে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ওঁরাও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব উপলক্ষে আনন্দের এমন আবহ তৈরি হয়েছিল শেরপুর কোঠাডাঙ্গা গ্রামে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার প্রত্যন্ত এই গ্রামের বাসিন্দারা জানালেন, ৪০ বছর পর দুই বছর ধরে সেখানে আবার উৎসবটি হচ্ছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর উৎসব আয়োজনের উদ্যোগ নেন মূলত গ্রামটির নারীরা। বুধ ও বৃহস্পতিবার দুদিনব্যাপী উৎসবকে ঘিরে গ্রামজুড়ে ছিল সাজসাজ রব।

গত বুধবার সন্ধ্যায় আখড়ায় কারামগাছের ডাল পুঁতে পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসব। এরপর রাতভর চলে নাচ-গান। পরদিন বিকালে আখড়ায় (বড় খোলা উঠান) পুঁতে রাখা কারাম ডাল তোলা হয়। এরপর মাদল-বাঁশি ও ঢোলের তালে তালে তালে নেচে-গেয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়ে পুকুরে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দুই দিনব্যাপী উৎসব। তবে এরপরও ছিল উৎসবের রেশ। সেদিনও গভীর রাত পর্যন্ত নারী-পুরুষ ও শিশুরা গান ও নাচে অংশ নেয়। ষষ্ঠ শ্রেণির তিন কিশোরী স্নান শেষে ভেজা কাপড়ে ধানগাছ, দূর্বাঘাস, ফুল ও সুতা দিয়ে কারাম ডাল সাজায় বুধবার সন্ধ্যায়। আগের রাত থেকে তারা নির্জলা উপোস ছিল। অন্যদিকে তিন কিশোর দূরের গ্রাম থেকে খিলকদমের ডাল কেটে নিয়ে আসে। তারাও উপোস করেছিল। নতুন ধুতি পরে তারা ডাল নিয়ে এলে কিশোরীরা ফুল ছিটিয়ে বরণ করে। এরপর নারীদের সঙ্গে নেচেগেয়ে আখড়ায় তিনটি ডাল পাশাপাশি পুঁতে দেয়া হয়।

গ্রামের মোড়ল ভোলা খালকো (৭৮) আখড়ায় বসে নারী-পুরুষ ও শিশুদের করম দেবতা ও পূজার সূচনার কাহিনি শোনান। এরপরই শুরু হয় নাচ-গান, যা চলে সারা রাত। ষাটোর্ধ্ব বিসরি এক্কা বললেন, আখড়ায় নাচতে গিয়েছিলেন। কিন্তু জামাইকে দেখে লজ্জায় শেষ পর্যন্ত অন্যদের সঙ্গে নাচে অংশ নেননি। সবাইকে আনন্দ করতে আর নাচতে-গাইতে দেখে খুব ভালো লেগেছে জানিয়ে বলেন, সামনের বচ্চরে আর শরম করব না। গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, একসময় কারাম ছিল ওঁরাওদের অন্যতম একটি উৎসব। কিন্তু খরচ ও আগ্রহের অভাবে প্রায় চার দশক আগে এটি বন্ধ হয়ে যায়। মিনতি বাকলা নামে গ্রামটির চল্লিশোর্ধ্ব এক গৃহবধূ দুই বছর আগে আবারও এ উৎসব আয়োজনের উদ্যোগ নেন।

মিনতি বাকলা বললেন, কারাম ছিল তাঁদের সবচেয়ে আনন্দের উৎসব। উৎসবটি হারিয়ে যেতে বসেছিল। ঐতিহ্য ধরে রাখতে উদ্যোগ নেন তিনি। উৎসবে মনের খুশিতে নেচেগেয়ে আনন্দ করেছেন বলে জানালেন মুঙলি কুজুর, সোহাগী টপ্প্য ও বিশাখা কুজুর। প্রবীণ এই তিন নারী জানালেন, বিয়েশাদি ছাড়া এখন নাচ-গান করার তেমন সুযোগ মেলে না। দুই বছর ধরে কারাম উৎসব হওয়ায় নেচেগেয়ে আনন্দের নতুন উপলক্ষ পেয়েছেন। শুধু গোমস্তাপুর নয়, দেশের উত্তর-পশ্চিমের অন্তত ১৬ জেলায় সমতলে বাস করা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা কারাম উৎসব উদ্যাপন করেন। ভারতের ঝাড়খন্ড, বিহার, ছত্তিশগড়, পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা ও আসামেও এই উৎসবের প্রচলন রয়েছে। এটি একটি ফসলসংশ্লিষ্ট উৎসব, যা ডালপূজা নামেও পরিচিত।

ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষে হওয়া এই উৎসব বা পূজায় করম দেবতার উপাসনা করা হয়, যাতে জমির উর্বরতা ও ফসলের ফলন বাড়ে। ওঁরাও সম্প্রদায়ের নেতা বঙ্গপাল সরদার বলেন, আদিবাসীদের সব উৎসব, পালাপার্বণ প্রকৃতিকে ঘিরে। কারাম ডাল যেমন ভ্রাতৃত্বের প্রতীক, তেমনি নতুন ফসল বপনের আচার প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের অটুট সম্পর্কের প্রতীক। উৎসব মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, সহযোগিতা ও ঐক্যের বন্ধনই সমাজকে টিকিয়ে রাখে। আধুনিকতার ঝড় যতই আসুক, ঐতিহ্যের এই উৎসব আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে।