শিশু নগরীর ১৬০ জন এতিম শিশুর অন্যরকম ঈদ উদ্যাপন

অনলাইন ডেস্ক: ঈদের সকালে নতুন জামা পরে মায়ের হাতের খাবার খাওয়া, বাবার হাত ধরে ঈদের নামাজে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া, আত্মীয়-প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, ঈদ সালামি পাওয়া কিংবা বিকেলে ঘুরতে যাওয়াতো বাঙালির ঈদের চির পরিচিত রূপ। আর ঈদ ঘিরে প্রতিটি শিশুরই থাকে নানারকম স্বপ্ন, আবদার আর আয়োজন। ঈদের দিন ধনী গরীব সব পরিবারের শিশুরাই পরিবারের সামর্থ্য অনুযায়ী এসব আনন্দের মধ্যেই ঈদ উদ্যাপন করে থাকে। কিন্তু এতিম শিশুদের ঈদ কেমন থাকে? তাদের জন্য এই দিনটাতে আলাদা করে কেউ কি ভাবেন?
কেউ কেউ তো ভাবেনই। তারা এসব শিশুদের পাশে দাঁড়ান। তাদের আনন্দের জন্য আয়োজন করেন নানা কিছুর। পঞ্চগড়ের আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীর ১৬০ জন এতিম শিশুর ব্যতিক্রম ঈদুল আযহা উদ্যাপন সেই বার্তাই দিচ্ছে।
বাবা-মা নেই। নেই আপনজন। ঈদ উপলক্ষে বিশেষ কোনো প্রস্তুতি নেই। বাড়ি ফেরারও তাড়া নেই। তাদেরই মুখে হাসি ফুঁটিয়েছে আহছানিয়া মিশন। ঈদ সেলামি, নতুন পোশাক, একসাথে ঈদের নামাজ পড়া এবং খাবার খাওয়ার মধ্যে দিয়ে আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীর এতিম শিশুরা এক অন্যরকম ঈদ আনন্দ উপভোগ করলো। পরিবার না থাকলেও ঈদের দিনে তারা পেয়েছে একসাথে আনন্দ ভাগাভাগি করার মতো একটি নিরাপদ আশ্রয় আর ভালোবাসা।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জলাপাড়া গ্রামে অবস্থিত আহছানিয়া মিশন শিশু নগরী। ঢাকা আহছানিয়া মিশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ১৬০ জন এতিম, পথশিশু ও পরিবারহীন শিশুর ঠিকানা হয়ে উঠেছে। এখানকার অধিকাংশ শিশুই শৈশবে হারিয়ে যাওয়া বা পরিত্যক্ত, যাদের কারো বাবা-মা নেই, কারো পরিবার খুঁজে পাওয়া যায়নি, আবার কেউ নিজের পরিচয় জানে না।
গতকাল ঈদুল আযহা উপলক্ষে শিশু নগরীর ভেতরেই আয়োজন করা হয় কোরবানির। শিশুদের জন্য কোরবানি দেওয়া হয় একটি গরু। নামাজ শেষে সবাই মিলে পোলাও, মাংস, কোমল পানীয়, হালুয়া আর মিষ্টান্ন খাওয়ারও আয়োজন করা হয়। প্রতিটি শিশুকে দেওয়া হয় ৩০ টাকা করে ঈদ সেলামি। যা ছিল তাদের জন্য এক অভাবনীয় উপহার। সামান্য হলেও তাদের মুখের হাসিই বলে দেয় কতটা পরিতৃপ্ত তারা।
শিশু নগরীতে কথা হয় সাত বছরের শিশু পারভেজের সঙ্গে। মায়ের নিষ্ঠুরতার শিকার এই শিশু এক বছর আগে এই নগরীতে আসে। মা পারভীন বেগম পারভেজকে পরিত্যাগ করলে তার ঠাঁই হয় এখানে। তবে স্বজনহীন এই শিশু যেন এখানেই ঈদের পূর্ণ আনন্দ উপভোগ করছে। নতুন পোষাক, ভালো খাবার আর ঈদ সেলামি মনে করতে দেয়নি পরিবারের শূন্যতা। ঈদ কেমন কাটলো জানতে চাইলে তার অকপট জবাব, ‘খুব আনন্দ করেছি’!
পারভেজের বয়সি আকাশ। খুব চঞ্চল প্রকৃতির এই শিশুটিও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। সে জানেনা তার বাবা-মা কোথায় আছে। শুধু মনে রেখেছে মায়ের নাম শিরিন এবং বাবার নাম সোয়েল। বাবা-মার কথা জিজ্ঞেস করতেই থেমে যায় ছোট্ট আকাশ। বিষণ্ন জবাব, ‘বাবা-মার কাছে থাকলে আনন্দ বেশি হতো’!
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ২০১৩ সালে শিশু নগরীতে আসে সুজন ইসলাম। গত বছর পঞ্চগড় সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি পাশ করে এখন দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে।
সুজন বলেন, ‘আমার বাবা-মা নেই, নিজের কোন ঠিকানাও জানা নেই। এখন পর্যন্ত এই নগরীই আমার ঠিকানা। প্রতিবছর ঈদ এলে এখানেই আনন্দ উপভোগ করি। সবাই মিলে খাই, খেলি, ভালো লাগে!’
কিশোর সুমনের অকপট জবাব,‘ছোটবেলা থেকেই এখানে আছি। এখানেই মানুষ হয়েছি, এবার এসএসসি পাস করেছি। বাড়ি বলতে এখন এই আশ্রয়টাকেই মনে হয়। ঈদের দিন সবাই মিলে আনন্দ করি। তখন আর মন খারাপ থাকে না!’
বিপ্লব বাবু ১০ বছর ধরে এই শিশু নগরীতে আছে। সে জানায়, ঈদের দিন বাড়ির কথা মনে পড়ে, মন খারাপ হয়। তবে এখানে সবাই মিলে ঈদ করায় কিছুটা হলেও ভালো লাগে।
আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীর কৃষি কর্মকর্তা সেলিম প্রধান বলেন, শিশু নগরীতে শিশুর মানসিক উন্নয়ন ও নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু ঈদ নয়, সারা বছরই আমরা চেষ্টা করি এই পরিবারবিহীন শিশুরা যেন একটু হলেও পরিবারের স্বাদ পায়। ঈদে কোরবানি, নতুন জামা আর সেলামি দিয়ে আমরা ওদের আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করি।
আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীর সমাজকর্মী ইউসুফ আলী বলেন, আমরা আমাদের শিশু নগরীতে যেসব শিশু নিয়ে আসি তাদের বেশিরভাগ দেশের বিভিন্ন বস্তি ও রেল স্টেশন থেকে পাওয়া। আবার অনেকে হারিয়ে যাওয়া শিশু পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে দেয়। পুলিশ স্টেশন থেকেও এসব হারিয়ে যাওয়া শিশুদের আমরা নিয়ে আসি। তাদের এনে আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীতে ভর্তি করে তাদের খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা হয়। তাদের ১৮ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত আমরা সবরকম সহযোগিতা করি।
তিনি বলেন, ঢাকা আহছানিয়া মিশন হেড অফিস থেকে এসব শিশুর ব্যয়ভার বহন করা হয়। পরিবারে শিশুরা যেভাবে বেড়ে উঠে, ঠিক সেভাবে আমরা শিশুদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করি।
জানা যায়, ঢাকা আহছানিয়া মিশনের উদ্যোগে ২০১২ সালে পঞ্চগড়ে এই শিশু নগরীটি প্রতিষ্ঠিত হয় । এখানে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হয়। ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় এখান থেকে অংশ নিয়েছে ১২ জন শিক্ষার্থী। আগের দুই বছরেও ৬ জন করে শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল।
সূত্র: বাসস