টিটু-বাবুসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের ১৫ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার

রাজশাহী ও চাপাইনবাবগঞ্জে পুলিশের বিশেষ অভিযান
স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহীতে পুলিশের অভিযান জোরদার করা হয়েছে। রাজশাহী ও চাপাইনবাবগঞ্জে পুলিশের বিশেষ অভিযানে রাসিকের সাবেক মেয়র লিটনের পিএস আব্দুল ওয়াহিদ খান টিটু, রাজশাহী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর অঘোষিত ‘বডিগার্ড’ কাউসার আহমেদ বাবু ও নাচোলের সাবেক পৌর মেয়র, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে জুলাই বিপ্লবে ছাত্র জনতার ওপর হামলাসহ হত্যা মামলা রয়েছে। পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তারকৃতদের ওইসব মামলায় আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হবে।
নওগাঁর বদলগাছী প্রতিনিধি জানান, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) আব্দুল ওয়াহেদ খান টিটু নওগাঁর বদলগাছীতে স্থানীয় এক বিএনপি নেতার বাড়িতে লুকিয়েছিলেন। গতকাল শুক্রবার ভোররাত সাড়ে ৫টার দিকে ওই বাড়ি থেকেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, বদলগাছী উপজেলার চাকরাইল চৌধুরীপাড়া গ্রামে ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাগর চৌধুরীর বাসায় পাওয়া গেছে টিটুকে। এ সময় টিটুকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাগর চৌধুরীকেও নেয়া হয়েছে পুলিশ হেফাজতে। তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। গ্রেপ্তার আব্দুল ওয়াহেদ খান টিটু রাজশাহী মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তার বাড়ি রাজশাহী নগরের রাণীবাজার চিনিপট্টি মহল্লায়। বাবার নাম আব্দুল ওয়াদুদ খান।
টিটু তিনি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সেকশন অফিসার হলেও দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ছুটি ছাড়াই মেয়র লিটনের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং এই সময় দুই প্রতিষ্ঠান থেকেই বেতন গ্রহণ করেছেন। টিটুর বিরুদ্ধে অনৈতিকভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট দুই হাতে পিস্তল নিয়ে ছাত্র ও জনতার ওপর গুলি চালিয়ে ভাইরাল হওয়া সন্ত্রাসী জহিরুল হক রুবেল এই টিটুর বন্ধু। রুবেলকে নিয়ে কিশোর গ্যাং লালন, জমি দখল ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে টিটুর বিরুদ্ধে। এসব কারণে লিটন মেয়র থাকাকালেই তাকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। আওয়ামী সরকারের পতনের পর গত ৫ আগস্ট থেকেই আত্মগোপনে ছিলেন টিটু।
বদলগাছীর স্থানীয়রা জানান, টিটুকে আশ্রয় দেয়া বিএনপি নেতা সাগর চৌধুরী নওগাঁ জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি। সাগর চৌধুরী সাবেক ডেপুটি স্পিকার আক্তার হামিদ সিদ্দিকীর ছেলে বিএনপি নেতা আরেফিন সিদ্দিকী জনির অনুসারী। জনি মহাদেবপুর-বদলগাছি আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী।
শুক্রবার সকালে পুলিশ হেফাজতে থাকা সাগর চৌধুরী সাংবাদিকের জানান, টিটু হলেন তার প্রয়াত ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়। আত্মীয়তার খাতিরে বুধবার টিটু তার বাড়িতে আসেন, তাই তিনি ফিরিয়ে দেননি। তবে টিটুর উপস্থিতির খবর ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা পুলিশে খবর দেন।
বদলগাছি থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম জানান, ‘সাগর চৌধুরী ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তবে শুনলাম তিনি আগে থেকেই দল থেকে বহিষ্কৃত। তার বাড়ি থেকেই টিটুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। টিটুকে একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে। সাগরও এখনো পুলিশ হেফাজতে আছেন।’
নওগাঁ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাফিউল সারোয়ার বলেন, ‘সাগর চৌধুরী কেন টিটুকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাক আহম্মেদ জানান, গত ৫ আগস্ট রাজশাহীতে চলমান আন্দোলনের সময় নিহত সাকিব আনজুম হত্যা মামলার আসামি টিটু। এছাড়া ছাত্র ও জনতার ওপর হামলার একটি মামলারও এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। বদলগাছি থানা তাকে হস্তান্তর করলে ওই দুই মামলায়ও টিটুকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে।
এদিকে তানোর প্রতিনিধি জানান, রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর অঘোষিত ‘বডিগার্ড’ কাউসার আহমেদ বাবুকে (৩৭) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার বাবু জেলার তানোর পৌরসভার আমশো মহল্লার বাসিন্দা, বাবার নাম মৃত মফিজ উদ্দিন। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে নিজ বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে তানোর থানা পুলিশের একটি দল।
বাবু একসময় বিডিআরের সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে এবং পরে তিনি চাকরিচ্যুত হন। এরপর এলাকায় ফিরে তৎকালীন সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগীতে পরিণত হন। অস্ত্র ব্যবহারে দক্ষতার কারণে ওমর ফারুক চৌধুরী তাকে দীর্ঘদিন ধরে অঘোষিত ‘গানম্যান’ হিসেবে সঙ্গে রাখতেন।
গত বছরের ৫ আগস্টের আগপর্যন্ত বাবুকে সব সময় ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে দেখা যেত। সেই সময় তার কোমরে একটি পিস্তল ঝোলানো থাকত। স্থানীয়ভাবে তিনি ফারুক চৌধুরীর ‘বডিগার্ড’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তবে বাবু যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতেন সেটি তার নিজের, নাকি ওমর ফারুক চৌধুরীর লাইসেন্স করা অস্ত্র—তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে কোনো অস্ত্র উদ্ধার হয়নি।
তানোর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফজাল হোসেন বলেন, ‘বাবু সাবেক এমপি ফারুক চৌধুরীর গানম্যান বা বডিগার্ড ছিলেন কি না, তা আমি জানি না। তবে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।’ ‘বাবুর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলা রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন। সম্প্রতি এলাকায় ফেরার খবর পাওয়ার পরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
এছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ব্যুরো জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে পুলিশের বিশেষ অভিযানে সাবেক পৌর মেয়র, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে শুরু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত একযোগে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শুক্রবার দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার রেজাউল করিম।
পুলিশ সুপার রেজাউল করিম জানান, বিশেষ ওই অভিযানে জেলার সদর উপজেলায় চারজন, নাচোল উপজেলায় পাঁচজন, শিবগঞ্জ উপজেলায় দুইজন এবং গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট উপজেলায় একজন করে মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সদর উপজেলায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগ ঘরানার ব্যবসায়ী হাম্মাদ আলী। নাচোল উপজেলায় গ্রেপ্তার করা হয় পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র আব্দুর রশিদ খান ঝালু, ছাত্রলীগের দুই নেতা এবং আরও দুই স্থানীয় কর্মীকে। শিবগঞ্জে গ্রেপ্তার হন স্থানীয় দুই নেতা, আর গোমস্তাপুর ও ভোলাহাটে একজন করে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ সুপার আরও জানান, আগের দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলার ভিত্তিতে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে তাঁদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।