াকা | এপ্রিল ২, ২০২৫ - ১১:৫৪ পূর্বাহ্ন

জিম্মি ও নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রের মূল হোতা গ্রেফতার

  • আপডেট: Friday, April 25, 2025 - 11:17 pm

স্টাফ রিপোর্টার: বিদেশে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশী যুবকদের আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জিম্মি ও নির্যাতন করে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রের মূলহোতা জাহিদ হোসেনকে নওগাঁ থেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৫।

শুক্রবার বিকেলে র‌্যাব-৫ এর সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‌্যাব-৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মাসুদ পারভেজ।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি করানো হয় প্রতারণার শিকার কুড়িগ্রামের ইয়াকুব আলীকে। তিনি কুড়িগ্রাম জেলার ভোগরায় এলাকার ইনজল হোসেনের ছেলে।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানায়, কুড়িগ্রামের যুবক ইয়াকুব আলী প্রতারণার শিকার হয়ে আলজেরিয়া তিউনিসিয়া ও লিবিয়ায় আটকা পড়েন। এসময় তাকেসহ আরো বাংলাদেশি যুবকদের নানাভাবে নির্যাতন করে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ যাওয়া হতো। যার মূলে ছিলেন আসামি জাহিদ হোসেন।

লিবিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা বাংলাদেশে ফিরতে পারলেও পরিবার হারায় মোটা অংকের টাকা। গত ৯ জানুয়ারি ইয়াকুব আলী কুড়িগ্রামে এলে আসামিদের নামে সংশ্লিষ্ট থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

এ মামলার প্রেক্ষিতে ২৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার সময় নওগাঁ জেলার রাণীনগর থানার সিঙ্গারাপাড়া এলাকায় নিজ বসতবাড়ি থেকে মানব পাচার ও মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রের মূল হোতা জাহিদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয় প্রাথমিক জিজ্ঞাসা বাদে গ্রেফতারকৃত আসামি এ ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে। শুক্রবার রাতের মধ্যে আসামিকে কুড়িগ্রাম সদর থানায় হস্তান্তর করা হবে বলেও জানানো হয়।

র‌্যাব-৫ এর সদর দপ্তরে অশ্রু ভেজা চোখে প্রবাস জীবনের কষ্টের কথা তুলে ধরে ইয়াকুব আলী সাংবাদিকদের জানান, ‘দেড় মাস গোসল করতে পারিনি। টয়লেটের পানি পর্যন্ত ছিল না।

পানি ও খাবারের জন্য আমরা (২৭ জন) সবসময় হাহাকার করেছি। মাঝে মাঝে আফ্রিকান দ্বারা কিছু খাবার পাঠাত। আফ্রিকানরা এসে কুকুরকে খাবার দেওয়ার মত মেঝেতে ঢেলে দিত। আমরা সেই খাবার কাড়াকারি করে খেতাম।’

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব অধিনায়ক জানান, প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরে ভুক্তভোগি ইয়াকুব বাদি হয়ে কুড়িগ্রাম সদর থানায় মামলা করেন। এই মামলায় মূলহোতা নওগাঁর রানীনগরের সিংগারাপাড়ায় এহরাম সরদারের ছেলে জাহিদ হোসেনকে (২৭) গ্রেপ্তার করা হয়।

বৃহস্পতিবার রাতে তার নিজ বাড়ি থেকে জাহিদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এই মামলায় জাহিদের বাবা এহরাম সরদার (৪০), তার ভাই বাবু মোল্লার (৫২) ও আব্দুল মান্নান (৫০) ছাড়াও ছয়জন আসামি। তাদের মধ্যে শুধু জাহিদ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে।

ইয়াকুব আলী প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘মুক্তিপন আদায়কারী জাহিদ হাসান থাকতেন লিবিয়াতে। লিবিয়ার বিভিন্ন আপেল বাগান, অভিজাত অফিসের ভিডিও দেখিয়ে বলতেন ইতালিতে থাকি।

সেখানে ভালো বেতনে চাকরি করছি। এমনভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালায়। এতে থেকে জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ইয়াকুবের। তার কথায় আশস্ত হয়ে উন্নত জীবনের আশায় ইতালিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইয়াকুব।

জাহিদের বাবা ইয়াকুবের সঙ্গে ২০ লাখ টাকার চুক্তি করেন। এরমধ্যে দেশে নেবেন ৫ লাখ। আর ইতালিতে পৌঁছার প্রথম সপ্তাহে বাকি ১৫ লাখ টাকা নেবে। এভাবে তার সঙ্গে চুক্তি হয়।’

ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে শাহজালাল বিমান বন্দর থেকে ২০২৩ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন ইয়াকুবসহ ২৭ জন। ইয়াকুব আলী বলেন, ‘সেদিন ঢাকা থেকে দুবাইগামী এমিরাত এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটে আমরা ২৭জন দুবাই পৌঁছায়।

দুবাই থেকে ফ্লাইটে নাইজার নিয়ে সড়ক পথে পাহাড়. পর্বত, মরুভূমি পাড়ি দিয়ে আমাদের আলজেরিয়ায় নিয়ে যায়। এই আলজেরিয়ায় আসতে আমাদের তিনদিন-তিন রাত লেগে যায়। এসময় তারা শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য খাবার দিয়েছে। এখানে দেড় মাসের মত অমানবিকভাবে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড রুমে আমাদের আটকে রাখে।’

খাবার, গোসলের কষ্ট উল্লেখ করে তিনি বলেন- ‘দেড় মাস আমরা কেউ গোসল করতে পারিনি। টয়লেটের পানি পর্যন্ত ছিল না। পানি ও খাবারের জন্য আমরা সবসময় হাহাকার করেছি। মাঝে মাঝে আফ্রিকান কয়েকজনের দ্বারা কিছু খাবার পাঠাত তারা। তারা কুকুরকে খাবার দেওয়ার মত মেঝেতে ঢেলে দিয়ে যেত। আমরা সেই খাবার কাড়াকাড়ি করে খেতাম।

সেই কষ্টের কথাগুলো মনে হলে চোখ দিয়ে এমনিতেই পানি ঝরে। পরবর্তিতে আলজেরিয়ার বর্ডার ক্রস করে তিউনিসিয়ায় নেওয়ার পরে আমাদের পুলিশ আটক করে। সেখানে জেলে থাকতে হয় ২১ দিন।

জেল থেকে বের হওয়ার পরে বুঝলাম- পুলিশের সঙ্গে তাদের সিন্ডিকেট। তারা (জিম্মিকারীরা) আমাদের আবার তাদের কবজায় নিয়ে নেয়। রাতের আধারে তিউনিসিয়ায় বর্ডার পাড়ি দিয়ে আমাদের লিবিয়ায় যায়।

সেখানে আটকে রেখে আমাদের নির্যাতনের জন্য আফ্রিকান ও পাকিস্তানী কিছু লোক রেখেছে তারা। সাউন্ড বক্সে গান বাড়িয়ে আমাদের মুখে গামছা পেচিয়ে মারধর ও নির্যাতন করে। সেই ছবি ও ভিডিও আবার দেশে পবিরারের কাছে পাঠিয়ে টাকা দাবি করে।’

র‌্যাব-৫ সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মাসুদ পারভেজ জানান, ইয়াকুব আলীর দুই বছর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাহিদ হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হয়।

পরিচয় সূত্রে আলাপচারিতায় সে ইয়াকুবকে জানায় যে, সে ইতালি প্রবাসী। ইতালিতে তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশের অনেক লোক তার মাধ্যমে ইতালিতে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ইতালির শ্রম বাজার, উচ্চ বেতন, শ্রমিকদের বিভিন্ন প্রকার সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি আকর্ষণীয় বিষয়ে ইয়াকুবকে প্রলোভন দিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রলুব্ধ করে।

২০২৩ সালের ১০ আগস্ট জাহিদ তার বাবা এহরাম সরদার (৪০) ও সম্পর্কে চাচা বাবু মোল্লার (৫২) সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন ইয়াকুবকে। এসময় ভিডিও কলে জাহিদের সঙ্গে কথা বলে ২০ লাখ টাকার প্যাকেজ চুড়ান্ত হয়।

এরমধ্যে অগ্রীম ৫ লাখ। আর অবশিষ্ট ১৫ লাখ ইতালী পৌঁছে কাজে যোগদান করার প্রথম সপ্তাহে দিতে হবে। অগ্রীম ৫ লাখ টাকা পরিশোধের ৩ মাসের মধ্যে জাহিদকে ঢাকা হতে দুবাই এবং দুবাই থেকে ইতালি নিয়ে যাওয়া হবে।

এরমধ্যে জাহিদ ইয়াকুবের ফ্লাইটের দিন, তারিখ ও সময় নিশ্চিত করে আব্দুল মান্নানকে জানায়। জাহিদ এসময় আব্দুল মান্নানকে জানায়, ঢাকা শাহজালাল বিমান বন্দর হতে ফ্লাইটে তার আরো ২৬জন লোক যাবে। তাদেরকে গাইড করে নিয়ে যেতে হবে তাকে।

শাহজালাল বিমান বন্দর থেকে ২০২৩ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর দুবাইগামী এমিরাত এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ইয়াকুবসহ আরও ২৭ জন ভুক্তভোগী দুবাই পৌঁছায়।

দুবাই থেকে ফ্লাইটে নাইজার নিয়ে সড়ক পথে আলজেরিয়া যাওয়ার পর আলজেরিয়া পুলিশ তাদের সকলকেই ধরে নিয়ে গেলে তাহারা ২১ দিন জেল খাটে। জেল হতে মুক্তি পাওয়ায় পরে আব্দুল মান্নান ও জাহিদ তাদের সকলকেই নিয়ন্ত্রণে নেয়। এরপরে জাহিদ ও আব্দুল মান্নান তাদেরকে আলজেরিয়া হতে সড়ক পথে তিউনিশিয়া নেয়।

তিউনিশিয়া হতে লিবিয়া নিয়ে তাদের সকলকেই একটি বাড়িতে জিম্মি করে জাহিদের নেতৃত্বে ইয়াকুবসহ অন্যান্য জিম্মিদের অমানষিকভাবে নির্যাতন করে ও পরনের কাপড় খুলে বিবস্ত্র করে ছবি তুলে এবং ভিডিও ধারণ করে দেশে তাদের পরিবারের সদস্যদের নিকট পাঠায়। এসময় ইয়াকুবসহ অন্যদের থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।

বাদী অন্যান্য ভুক্তভোগীদের নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে মুক্তিপণ দাবি করার সংবাদ বাংলাদেশের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়ায় প্রকাশ ও প্রচার হওয়ায় লিবিয়ায় অবস্থিত দুতাবাসে কর্মরত মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মো. খাইরুল বাশার তাদের উদ্ধার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়।

র‌্যাব-৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মাসুদ পারভেজ বলেন, চলতি বছরের গত ৯ জানুয়ারি দেশে ফেরৎ আসেন ইয়াকুব। এরপরে ২৫ মার্চ কুড়িগ্রাম সদর থানার মামলা (নং-১৭) দায়ের করেন।

তারই ধারাবিকতায় র‌্যাব-৫, নওগাঁর রানীনগরে অভিযান চালিয়ে জাহিদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামি জাহিদ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন।

গ্রেপ্তারকৃত আসামিকে কুড়িগ্রাম সদর থানায় হস্তান্তর করা হবে।

Hi-performance fast WordPress hosting by FireVPS