ঢাকা | এপ্রিল ২০, ২০২৫ - ৯:৫০ পূর্বাহ্ন

প্রমত্ত পদ্মা স্রোতহীন, শাখা বড়ালের অবস্থা বেহাল

  • আপডেট: Friday, April 18, 2025 - 11:16 pm

মোজাম্মেল হক, চারঘাট থেকে: মায়ের বুকে দুধ না থাকলে বাচ্চার খাবার জোটে কীভাবে! ঠিক এমনটায় হয়েছে বড়াল নদীর ক্ষেত্রে। প্রমত্ত পদ্মা নিজেই স্রোতহীন তাই তার শাখা বড়াল নদের বেহাল অবস্থা। কালের বিবর্তনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে পদ্মার শাখা নদ বড়াল। বড়াল নদীর উৎপত্তি রাজশাহীর চারঘাট থেকে পদ্মা নদীর শাখা নদী হিসেবে। চারঘাট থেকে বাঘা, নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে বাঘাবাড়ী হয়ে এটি হুড়া সাগরে মিশে নাকালিয়া নামক স্থানে যমুনা নদীতে পড়েছে।

এক সময় যোগাযোগের সুবিধার কারণে বড়াল নদের দুই পাড়ে বাজার, চারঘাট উপজেলা পরিষদ, চারঘাট মডেল থানা, স্কুল, কলেজ, পুলিশ একাডেমি, দয়ারামপুর, সেনানিবাসসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গড়ে উঠেছিল। বড়াল নদীর তীরে গড়ে ওঠা আড়ানী বাজার ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা কেন্দ্র। বর্তমানেও বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসা কেন্দ্র এটি। বড়াল নদীকে কেন্দ্র করেই মূলত এই নদীবন্দরটি গড়ে উঠেছিল। আজ বড়াল মৃতপ্রায়।

স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে জানা যায়, একটা সময় যোগাযোগের অন্যতম বাহন ছিল নৌকা। সেই নৌকা চালিয়ে যারা জীবনধারণ করেন অঞ্চলভেদে তারা মাঝি, মাল্লা, নাওয়া, নৌকাজীবী, নৌকাচালক, কান্ডারি, পাটনি, কর্ণক ইত্যাদি নামে পরিচিত। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে এক কালের খরস্রোতা নদ বড়াল শুকিয়ে তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। যার কারণে এক কালের চির যৌবনা বড়ালের বুকে দেখা মেলে না মাঝি-মাল্লার।

এখন নদীটির নাব্যতা হারিয়ে কৃষকের ফসলের মাঠে পরিণত হয়েছে। নদের বুকে ধান, গম, মশুরসহ বিভিন্ন ফসলের জন্য হালচাষ করা হচ্ছে। উজানে বাঁধ দিয়ে চাষাবাদের জন্য সেচ দেয়া হয়। বাঁধ নির্মাণ এবং যাতায়াতের জন্য নদের বুকে একাধিক ব্রিজ নির্মাণ করে নদের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে। স্থানীয় জেলেরা বলেন, এক সময়ে এই বড়াল নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা হলেও এখন আর নদীতে মাছ শিকার করা হয় না। বড়ালে পানি না থাকায় জেলেরা আজ অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ১৯৮১-৮২ অর্থ বছরে নদের তীরবর্তী উপজেলাগুলোকে বন্যামুক্ত করার জন্য উৎসমুখ চারঘাটে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক গতি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে সুইসগেট ও বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।

বিভিন্ন স্থানে সুইসগেট ও বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্রমান্বয়ে বড়াল নদ শুকিয়ে শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। বর্ষায় নদে কিছু পানি জমলেও শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই শুকিয়ে মরা নদে পরিণত হয়। এ সুযোগে এ সময়ে এলাকার কৃষকরা নদের বুকজুড়ে ফসলের আবাদ করেন। পরিণত হয় গবাদী পশুর চারণ ভূমি হিসেবে। এক সময় যে বড়ালের পানির সেচে নদের তীরবর্তী মানুষ তাদের জমিতে ফসল ফলাত এখন সে নদের বুকে অগভীর নলকূপ বসিয়ে চলে ইরি চাষ।

নদ আছে, নৌকা আছে, নেই শুধু পানি। শুধু তাই নয়, নদে পানি না থাকায় এ নদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রগুলো তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এছাড়া প্রতিদিনের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করায় পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। চারঘাট বড়াল নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বাদশা বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ যদি খননের মাধ্যমে বড়াল নদের প্রাণ ফেরানোর চেষ্টা করে তবে শুধু অর্থের অপচয় হবে কোনো কাজ হবে না।

নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নদীতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ সচল করতে হবে এবং এর জন্য চারঘাট রামাগাড়িসহ সমস্ত সুইস গেট ও বাঁধ অপসারণ করতে হবে। তবেই আমরা আবার ফিরে পেতে পারি আমাদের খরস্রোতা বড়াল নদী। বড়ালের নাব্যতাহীনতা ও নদীর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বড়ালের জেলে পরিবার।