রাজশাহীতে দুর্ভোগ পোহালেন হাজারো ট্রেনযাত্রী
স্টাফ রিপোর্টার: প্ল্যাটফর্মে বসার জায়গায় শুয়ে হাসি খাতুন। পাশে বসে স্বামী জাহিদুল ইসলাম। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে এই দম্পতি মঙ্গলবার রাজশাহী এসেছিলেন ডাক্তারের কাছে। বুধবার সকালে বাড়ি ফেরার জন্য রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে জানতে পারেন ট্রেন বন্ধ। অসহায়ের মত জাহিদুল বললেন, ‘রোজার-রমজানের দিনে এমন আন্দোলন মানাই? এখন বাজে সাড়ে ১০টা। ৮টায় এসে বসে আছে। এভাবে হয়রানি করা কি উচিত?’
রেলওয়ে রানিং স্টাফ (চালক-গার্ড) ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতির ডাকা আকস্মিক কর্মবিরতিতে এমন হয়রানির শিকার হয়েছেন হাজারো যাত্রী। সকালে রাজশাহী থেকে ঢাকা ও খুলনাগামী ট্রেনের যাত্রা বাতিলের পর যাত্রীরা বাসে চড়ে গন্তব্যে যান। তবে হঠাৎ যাত্রী বেড়ে যাওয়ায় বাসেও টিকিট পেতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাদের। আবার অনেকে দীর্ঘ সময় স্টেশনে অপেক্ষা করে শেষপর্যন্ত ট্রেনেই নিজ নিজ গন্তব্যে যাত্রা করেন।
ট্রেন বন্ধ রেখে চালক-গার্ডদের দাবী আদায় হলেও এ ধরনের কর্মসূচি নজিরবিহীন বলছেন ট্রেনের যাত্রীরা। রেলের মত সরকারি সেবা বন্ধ করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও দেখিয়েছেন কোন কোন যাত্রী। বুধবার সকাল থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত রাজশাহী থেকে কোন ট্রেন ছেড়ে যায়নি। স্টেশনে কোন ট্রেন আসেওনি। তবে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের মাইলেজ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার করার পর দুপুর সাড়ে ১২টার পর ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্টেশনে বসে ছিলেন হাজেরা বেগম, মাজেদা বেগম ও মমেনা বেগম। তারা তিন বোন। বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার সসিদারপুর গ্রামে। রাজশাহী এসেছিলেন ডাক্তারের কাছে। তিন দিন রাজশাহীতে থেকে চিকিৎসা করেছেন। তারা জানালেন, লোকাল ট্রেনে তারা ৫০ টাকায় বাড়ি ফিরতে পারবেন। আন্তঃনগরে গেলে ভাড়া লাগবে ১৫০ টাকা। তিন দিন রাজশাহীতে থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসার খরচ মেটাতে সব টাকা শেষ। শুধু ৫০ টাকা করে ট্রেন ভাড়া দিয়ে বাড়ি ফেরার টাকা আছে। ট্রেন বন্ধ করায় তারা বেকায়দায় পড়েন।
হাজেরা বেগম মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘বিকাশে কিছু টাকা-পয়সা পাঠাও। আমরা বাড়ি আসি।’ কথা শেষে হাজেরা বললেন, ‘বাসে কুষ্টিয়ার ১২ মাইল পর্যন্ত যেতেই জনপ্রতি লাগবে ৩০০ টাকা। তারপর আবার বাসে ২০ টাকা, অটোতে ২৫ টাকা আর ভ্যানে ১০ টাকা লাগবে। ট্রেন চললে ৫০ টাকাতেই বাড়ির কাছে নামতে পারতাম। আমরা চিকিৎসা করাতে এসেছি। সব টাকা শেষ। এখন তো বিপদে পড়েছি।’
রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরে যাওয়ার জন্য স্টেশনে বসেছিলেন মাইনুল ইসলাম। তিনি বললেন, ‘ট্রেনের মত সরকারি সেবা বন্ধ জীবনে প্রথম দেখলাম। সরকারি সেবা বন্ধ হবে কেন? মগের মুল্লুক নাকি?’ পাশে বসা সাদিদ মো. সদরউল্লাহ বললেন, ‘ট্রেন, অ্যাম্বুলেন্স, ডাকবিভাগ- এগুলো জরুরি সেবা। এগুলো কি বন্ধ হবার কথা? এদের কি করা উচিত? কেউ কিছু বলার নাই তো। যার যা ইচ্ছা সে তাই করছে। আমরা জনগণই জিম্মি।’
যাত্রীরা এভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও সে সময় স্টেশনে চালক ও গার্ডরা ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে ছবি তুলছিলেন। সেখানে থাকা গার্ড কাউন্সিলের পশ্চিম জোনের সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক হোসেন বলেন, ‘অতিরিক্ত কাজের পারিশ্রমিক আমাদের অন্যায়ভাবে বন্ধ করা হচ্ছে। সরকার এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে ট্রেন বন্ধই থাকবে।’ এর কিছুক্ষণ পরই রানিং স্টাফদের বেতন-ভাতা বাতিলের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার করা হবে বলে ঢাকায় ঘোষণা দেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। এরপর রাজশাহীতেও ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার জানান, পশ্চিম জোনে ৫৬টি আন্তঃনগর, ৬২টি মেইল ও লোকাল ট্রেন এবং ২০টি মালবাহী ট্রেন চলে। সবগুলোই বন্ধ ছিল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যেসব ট্রেন যেতে পারেনি সেগুলোর যাত্রা বাতিলই করা হয়েছে। এভাবে পরবর্তী ট্রেনের সিডিউল ঠিক রাখা হয়েছে। বাতিল ট্রেনগুলোর টিকিটের টাকা কাউন্টার থেকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। সকাল ৭টা থেকে ৯টার মধ্যে শুধু রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন থেকেই যাত্রীদের ১২ লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।