ঢাকা | মার্চ ১৫, ২০২৫ - ৭:০৫ অপরাহ্ন

শিরোনাম

রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতে ‘জাতীয় সনদ’ ও ঐকমত্য তৈরি হবে : বদিউল আলম মজুমদার

  • আপডেট: Saturday, March 15, 2025 - 1:12 pm

অনলাইন ডেস্ক: রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণীত হবে। এই সনদ প্রণয়নের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অঙ্গীকার ব্যক্ত করবে। আর এই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হবে।

জাতীয় বার্তা সংস্থা বাসস-কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ কথা বলেন।

ড. আলম বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো প্রস্তাবগুলোতে একমত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। গণতন্ত্রে মতের পার্থক্য থাকাটা দোষের কিছু নয়, এটা থাকতেই পারে। কিন্তু একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কতগুলো মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এবার আমাদের সেই সুযোগ ও মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে। অতীতের ক্ষুদ্র যে বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের মধ্যে মতানৈক্য বিরাট আকার ধারণ করেছে। তার উর্ধ্বে উঠতে হবে। আমি এ ব্যাপারে আশাবাদী।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টেকসই ও কার্যকর করার ব্যাপারে ‘জাতীয় সনদ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কারণ এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামত ব্যক্ত করবে এবং সেই জাতীয় সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে, তাতে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে তারা তাদের অঙ্গীকার ব্যক্ত করবে। আমি মনে করি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক হবে।’

টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বিষয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘গণতন্ত্র আকাশ থেকে পড়বে না, কিংবা হাওয়ায় ভেসে আসবে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আমাদের অঙ্গীকার এবং এ সম্পর্কে করণীয়, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য অঙ্গীকার এবং একই সাথে করণীয়টা যদি করি তাহলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে ১১ টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে এর মধ্যে ছয়টি ইতোমধ্যে তাদের সুপারিশগুলো জমা দিয়েছে। এগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে শেয়ার করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি কার্যকর করতে হয় তাহলে এর প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের রাজনীতিবিদদের। কারণ রাজনীতিবিদরাই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। অতএব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য তাদেরকেই প্রাথমিক ভূমিকা পালন করতে হবে। এরসাথে অবশ্য নাগরিক সমাজকেও সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সাথে নাগরিকরাও যদি অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে, তাহলেই এটা সহজ হবে। আমরা ঐকমত্য কমিশন যা করার চেষ্টা করেছি তা হলো- ছয়টি সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে এগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছি। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমরা মতামত চাই যে, তারা এগুলোর সাথে একমত, দ্বিমত কিংবা আংশিকভাবে একমত কি না। যেসব বিষয়ে তারা একমত সেগুলো কি প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়িত হবে এটা তারা আমাদেরকে জানাক।’

অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো জাতির সামনে অনেক অঙ্গীকার করেছে, কিন্তু  অনেক ক্ষেত্রেই সে অঙ্গীকারগুলো রক্ষা করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অঙ্গীকার রক্ষা করতে না পারার নানা কারণও রয়েছে। এবার আমরা আশাবাদী, কারণ এবার যে এতো রক্তপাত হলো, এতো লোক প্রাণ দিলো, এতো লোক আহত এবং নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হলো। এটা একটা ভিন্ন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। এই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এবং সকল নাগরিকের পক্ষ থেকে একটা দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি আশা করি এবার পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পর তারা যে অঙ্গীকারগুলো করবে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থা রাখতে চাই।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই সদস্য মনে করেন, সবার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের লাল কার্ড দেখানোর সুযোগ হয় অর্থাৎ প্রতি পাঁচ বছর পর পর যদি রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের কাছে ফিরে আসতে হয়, তাহলে জনগণ তাদেরকে যদি না বলতে পারেন, যদি তাদের লাল কার্ড দেখাতে পারেন তাহলে জনগণের স্বার্থে এবং জনগণের মতামতের ভিত্তিতে তারা সরকার পরিচালনা করবে। কিন্তু নির্বাচন ব্যবস্থা যদি ভেঙ্গে যায় নির্বাচন ছাড়াই যদি ক্ষমতায় আসা সম্ভব হয়, ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয়, তখন মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার কাঠামো আর থাকে না। একই সাথে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের কারণে যেসব ব্যক্তির সংসদে বসে সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার কথা সেটাও আর কার্যকর হয় না, কারণ এরা কেউ জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। তারা একই দলের হওয়ায় মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে নিজেদের কল্যাণই বেশি করেছে। তাই আমরা মনে করি যে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন হবে এবং তারা মানুষের কল্যাণের প্রতি মনোনিবেশ করবে এর জন্য দরকার নির্বাচনী ব্যবস্থাটা সঠিক হওয়া।

নির্বাচনে সঠিক ও যোগ্য লোকদের নির্বাচিত হওয়ার প্রশ্নে নির্বাচনী অঙ্গন থেকে দুর্বৃত্তদের বিতাড়িত বরার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে কারা নির্বাচিত হয়ে আসবে, এটাও জরুরি অর্থাৎ আমাদের নির্বাচনী অঙ্গন থেকে দুর্বৃত্তদের তাড়িয়ে দিতে হবে, নির্বাচনের অঙ্গনকে পরিচ্ছন্ন করা এবং এই অঙ্গনকে দুর্বৃত্তমুক্ত করা দরকার। নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা যেসব তথ্য দেয়, সেই তথ্যগুলোর সঠিকতা যাচাই করা গুরুত্বপূর্ণ। যাতে সঠিক ব্যক্তি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন।

টাকার খেলা বন্ধ করার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে টাকার খেলা যদি বন্ধ করতে না পারি, তাহলে সবই পণ্ডশ্রম হবে। কারণ টাকার খেলা বন্ধ না হলে এটা হবে এমন গণতন্ত্র যা টাকা দিয়ে কেনা যায়। কিন্তু এটা কোন গণতন্ত্রই নয়। টাকার খেলা বিশেষ করে অদৃশ্য টাকার খেলা, মনোনয়ন বাণিজ্য, টাকা দিয়ে ভোট কেনা বন্ধ করতে হবে।’

নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা দরকার। কারণ সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের মূল দায়িত্ব উল্লেখ করে এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন কারণে অতীতে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা সত্ত্বেও তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। কারণ অতীতে সঠিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হয়নি এবং বিভিন্ন রকম চাপের মধ্যে তারা ছিল। আরেকটি বিষয়, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার যদি না থাকে, দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশের ইতিহাসে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। অতএব সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ একটি সরকার থাকা গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমরা আস্থা রাখতে চাই যে তারা জনগণের কল্যাণ ও স্বার্থে যারা রক্ত দিয়েছে তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। আমি আশাবাদী হতে চাই।’

জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য একটি ‘স্বাধীন কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ড. আলম বলেন, ‘এটি নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করবে না। নির্বাচন কমিশনের কাজ এনআইডি সম্পৃক্ত নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যখন এনআইডি সেবা নিতে চেয়েছিল আমরা আশঙ্কা করেছিলাম, আমি নিজেও এটার বিরোধিতা করেছি এবং সুপারিশও করেছি যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এনআইডি নেওয়াটা যেন বন্ধ করা হয়। কারণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রভাব খাটিয়ে ডাটাবেজটা ব্যবহার করতে পারে। নির্বাচন কমিশনের যা দরকার তা হলো একটি ভোটার তালিকা। এই ভোটার তালিকার যে অংশটা তাদের দরকার এবং অতি সহজে এই অংশটা তারা পেতে পারে। কিন্তু এনআইডি এখন সব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় এবং  এটি এখন একটি বিস্তৃত বিষয়। কেনাকাটা, জন্ম নিবন্ধনসহ সব কাজে এখন এনআইডির ব্যবহার হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনের ওপর মনোনিবেশ করা দরকার। তাই এনআইডি সংক্রান্ত কার্যক্রমের জন্যে একটা স্বাধীন কর্তৃপক্ষের সুপারিশ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের যা প্রয়োজন তার জন্যে এটাতে তাদের অ্যাক্সেস থাকবে। এনআইডি সংক্রান্ত কাজ করতে গিয়ে নির্বাচনের দিক থেকে ইসি’র দৃষ্টি যেন অন্যদিকে সরে না যায় সে কারণে আমরা এই স্বাধীন কর্তৃপক্ষের সুপারিশ করেছি।’

‘নির্বাচন কমিশন যদি নিরপেক্ষ হয় এবং সরকারের যদি কোন এজেন্ডা না থাকে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব উল্লেখ করে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘যারা একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে, তারাই আবার দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না।

এবার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালিত হবে। আমি নিশ্চিত যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবার ফেরত আসবে। এই প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পাবেন এবং তারা সঠিকভাবে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। আমি আশাবাদী ভবিষ্যতে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব।’

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কোনো রাজনৈতিক দল করার আকাঙ্ক্ষা কিংবা রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়া অথবা ভবিষ্যতেও রাজনীতি করার ইচ্ছে নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘উনি একজন সম্মানিত ও বিশ্বনন্দিত মানুষ। আমি নিশ্চিত যে উনি এটাকে কালিমা যুক্ত করবেন না। আর নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ারও কোনো ঝুঁকি দেখি না এবং যদি এই ঝুঁকি সৃষ্টিও হয় আমি নিশ্চিত প্রফেসর ইউনূস তার সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। এই মুহূর্তে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই।’

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের কোন ভাবনা নেই। এটা সরকারের এবং নির্বাচন কমিশনের বিষয়। তাদের নিবন্ধন বাতিল হবে কি হবে না, আইন-কানুন ও বিধিবিধানের আলোকে এ বিষয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। এগুলোর বিষয়ে আমাদের কোন মতামত নেই। সময় মতো নির্বাচন কমিশনই সিদ্ধান্ত নেবে, কে নির্বাচন করতে পারবে, কে পারবে না।’

সূত্র: বাসস