পরিবার নারীকে সাহস দিলে রাষ্ট্রও তার পাশে থাকবে : পরিবেশ উপদেষ্টা

অনলাইন ডেস্ক: পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, নারীর ক্ষমতায়নে সবার আগে পরিবার থেকে নারীকে সাহস দিতে হবে। যেকোনো সংকটে নারীর পাশে ঢাল হয়ে থাকতে হবে। পরিবার যদি পাশে না থাকে তাহলে রাষ্ট্রের পক্ষে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। পরিবার নারীকে সাহস দিলে রাষ্ট্রও নারীর পাশে থেকে সাহস জোগাতে পারে।
তিনি বলেন, ‘নারীর প্রতিবন্ধকতা কখনো শেষ হয় না। সমাজে একটা গোষ্ঠী আছে যারা নারীকে ক্ষমতায়িত করতে চায় না। দূর্বল নারীকে যত পছন্দ করে, সবলচিত্তের নারীকে তারা পছন্দ করে না। এটাই বাস্তবতা।’
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে জাতীয় বার্তা সংস্থা বাসস’কে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এসব কথা বলেন। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন : নারী ও কন্যার উন্নয়ন’।
উপদেষ্টা বলেন, একজন নারীকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তোলা হলে সে দেশের কাজে ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও পরিবারের পাশাপাশি সমাজেরও দায় রয়েছে। নারীর চলার পথ পুরুষের পাশাপাশি নির্বিঘ্ন ও নির্ভরতার হতে হবে।
তিনি বলেন, নারী এখন যে অবস্থানে রয়েছে সে অবস্থানে থেকে নারী বলে বিতর্কিত নয়, কাজে সে বিতর্কিত হোক, অদক্ষ বলে বিতর্কিত হোক, শুধু নারী বলেই ভূল, নারী বলেই অদক্ষ -এ কথাটা বলা যাবে না। আমি বলবো ‘স্কাই ইজ দ্য লিমিট, তাই তার চিন্তার গন্ডিটাকে তার পারিপার্শ্বিকতার নেতিবাচক মনোভাবে আটকে না রেখে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তাদেরকে পাশে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। অভিভাবককে বুঝতে হবে, ছেলে ও মেয়ে দু’জনেই পরিবারের সম্পদ। পরিবারের উচিত নারীকে ক্ষমতায়িত করা।
চলার পথে, পরিবারে এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি লিঙ্গ বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় উল্লেখ করে রিজওয়ানা হাসান তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘জীবনের যে কোনো অবস্থানে যাই না কেনো অবস্থান যত বড় হয়, বাঁধা গুলোও ততই কাঠামোগত হয়ে যায়।’ সামাজিক অবস্থানেও নারী এই বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে রেহাই পায় না।
তিনি বলেন, মানুষের যেখানে লৈঙ্গিক পরিচয় মুখ্য সেখানে পরিচয়কে মুখ্য করে তোলে। এটাই হলো সমাজের অবস্থা। এই জায়গা থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। তবেই সমাজের সকল বৈরি চিন্তা-চেতনা থেকে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন হবে।
উপদেষ্টা বলেন, নারী ও কন্যা শিশুকে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক মুক্তির কোনো বিকল্প নেই। নারীর প্রতি সকল ধরনের সহিংসতা কমিয়ে আনতে হলে তার শিক্ষা ও সাবলম্বী হওয়ার পথ প্রসারিত করতে হবে।
নারী কি এগিয়ে যাচ্ছে না পিছিয়ে যাচ্ছে এই প্রশ্নের জবাবে রিজওয়ানা হাসান বলেন, আগের চেয়ে মেয়েরা অনেক এগিয়ে এসেছে। আসলে নারী যত ক্ষমতায়িত হবে তার জন্য প্রতিপক্ষের বাঁধাগুলো তত বেশি জোরালো হবে।
প্রতিনিয়ত নারীর উন্নয়ন হয়েছে একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেই সরকারি ট্রেনিংয়ে যাই না কেনো সেখানে ৪০ জন পুরুষ থাকলে নারী থাকছেন ১০ জন। এটা বড় বিষয় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এই অবস্থাটা আমরা কয়েক বছর আগেও ভাবতে পারেনি। এটা ‘ওভারনাইট এমপাওয়ারমেন্ট’ হয়ে যাচ্ছে। আবার নারীর উন্নয়নে ধর্মকে বাঁধা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। সেখানে সংবেদনশীলতা অনেক বেশি থাকে। কাজেই উন্নত বিশ্বের মতো আইন করে ফেলতে পারছি না। আমি মনে করি শিক্ষাগত দিকে এবং ক্ষমতায়নের দিকে নারী এগোচ্ছে। এগুলো এখন বেশি চোখে পড়ে কারণ, এখন রেজিট্যান্সও বেড়েছে। নারী বের না হলে এতো বাঁধাও আসতো না। সেকারণে সেভাবে আগে এতো মেয়ে বের হতো না, বাঁধাও আসতো না। এখন অনেক লোক বেড়েছে, তাই বাঁধাও আসছে।’
নারী যতই উপরে উঠবে কাঠামোগত রেজিট্যান্সগুলো তার জন্য আরো বেশি শক্ত হয়ে যাবে। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পরিবর্তন হলেই নারী ও শিশুর মনোজগত গঠন সুন্দর হতে পারে।
এক্ষেত্রে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জেন্ডার পলিসি থাকা উচিত এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষার্থী যৌন নিপীড়নের শিকার হলে তাকে যেন বলা না হয়, তুমি মুখ খুলবে না। কমপ্লেনটা নিয়ে ডিল করতে হবে। তবে এমনভাবে করবে যেন মেয়েটাকে বাড়তি হয়রানির মধ্যে দিয়ে যেতে না হয়। অপরাধীও জানতে পারবে, এ ধরনের অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না। তাহলে সমাজে ইভটিজিংসহ এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে। কার্পেটের নিচে সমস্যা রাখা যাবে না। সমস্যাকে বের করে এনে মোকাবেলা করে সমাধান করতে হবে।
মেয়েদের নিজেদের উন্নয়নে অর্থনৈতিক স্বাধিকারের জায়গায় আপস করা ঠিক হবে না। তার নিজের উন্নয়নে নিজেকেই ভূমিকা রাখতে হবে উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কর্মপরিবেশে একজন নারীকে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। নারী ও শিশুকে পিছনে রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়, তাদের নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। যেখানে ওয়াসফিয়া নাজরীন আর নিশাত মজুমদারের মতো মেয়েরা পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে সেখানে আমাদের মেয়েরা ফুটবল খেলতে গেলে বলে এটা অনৈসলামিক। এটা করতে দেবো না। এটা হচ্ছে নেগেটিভ মানসিকতা। এই নেগেটিভ মানসিকতাকে ভাঙতে হবে। সেসব খেলোয়াড় মেয়েদের বলতে হবে, ‘তা হবে না, ডিসি সাহেব আমরা খেলবো’। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেয়েদের তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের সমাজে আমরা প্রথাগতভাবে বলে ফেলি, যা নারীর ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে যায়। চাকরি করে সংসার করা যায়। অবশ্যই সংসার দেখবে। মা ও বাবা দু’জনের যৌথভাবে সংসারে ভূমিকা রাখবে।
যদি কেউ ধর্ষিত হয়, তবে আইনের দীর্ঘসূত্রিতায় না গিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে এধরনের কাজ কমে যাবে। নারীকে সেক্স অবজেক্ট থেকে বের করে আনতে হবে। সেজন্য ছোটবেলা থেকেই পরিবারের ছেলেটিকে মেয়েদের সম্মান দিতে এবং সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বেড়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে হবে পরিবারকেই।
সূত্র: বাসস