তিন বছর পর উন্মুক্ত হচ্ছে রঘুনাথ মন্দিরে প্রবেশদ্বার
মান্দা (নওগাঁ) প্রতিনিধি: করোনাকালিন পরিস্থিতিতে দীর্ঘ তিনবছর বন্ধ থাকার পর পূণ্যার্থীদের জন্য আবারো উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে ঐতিহাসিক ঠাকুরমান্দা রঘুনাথ জিউ মন্দিরের প্রবেশ দ্বার। আগামি ১০ এপ্রিল রামের জন্মতিথির উৎসবকে ঘিরে এরই মধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছে মন্দির কমিটি। চলছে মন্দির পরিস্কারসহ ধোঁয়া-মোছার কাজ। একই সঙ্গে সাজসজ্জার কাজ চলছে মন্দির প্রাঙ্গনে।
এবারে রামের জন্ম উৎসবকে সার্বজনীন উৎসবে পরিণত করতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে এর প্রবেশদ্বার। ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার সঞ্জিব কুমার ভাট্টি ও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এমপি এ উৎসবে উপস্থিত থাকবেন এমনটিই জানিয়েছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঠাকুরমান্দা রঘুনাথ জিউ মন্দিরকে ঘিরে প্রতিবছর চৈত্র মাসে রামের জন্মতিথির উৎসব পালন করা হয়। রামনবমীর ৯ দিন ব্যাপি মেলায় হিন্দু পূণ্যার্থীসহ লাখো মানুষের ঢল নামে এই জনপদে। জনপদটি নওগাঁর মান্দা উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক। প্রাচীন এই জনপদের নামেই মান্দা উপজেলার নাম পরিচয় হয়। ইংরেজ আমলে মান্দা থানা পুলিশ স্টেশনও ছিল এখানেই।
মান্দা উপজেলা সদর প্রসাদপুর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ঐতিহাসিক ঠাকুরমান্দা জনপদ। আত্রাই নদীর অন্যতম শাখা শিবনদ ও বিলমান্দার পশ্চিম তীরে জনপদটির অবস্থান। বর্ষাকালে শিবনদের পূর্ব তীরে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে দাঁড়ালে জনপদটি অথৈ পানিতে ভাসা একটি দ্বীপ বলে মনে হয়।
জনপদটি নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে, নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৪০ ও রাজশাহী থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ‘রাজখাড়া’ জমিদারি স্ট্রেটের কাচারি বাড়ির ভগ্নাবশেষ এখনও কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে রঘুনাথ মন্দিরের পাশে।
কথিত আছে জনপদটিতে বাস করতেন দরিদ্র এক অন্ধ ব্রাহ্মণ। তিনি রামভক্ত ছিলেন। বিলে স্নান করতে নামলে রাম, লক্ষণ, সীতা ও হনুমানের কাঠের বিগ্রহগুলো ভাসতে ভাসতে তাঁর শরীর স্পর্শ করে। তিনি প্রণাম করে মূর্তিগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরেন।
পরে সেগুলো বাড়িতে স্থাপন করে পুজা-অর্চনা শুরু করেন। পুজাকালে একদিন হঠাৎ করেই দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান। তার সংসারে স্বচ্ছলতাও ফিরে আসে। তখন থেকেই এই রঘুনাথ বিগ্রহের অলৌকিত্বের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বাড়তে থাকে ভক্তদের ভিড়।
এক পর্যায়ে কথাগুলো পৌঁছে যায় নাটোরের জমিদার রানী ভবানীর কানে। মন্দির দর্শনে এসে এর জীর্ণতা দেখে নিজেই মন্দির তৈরি করে দেন। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজও মন্দিরটির এই অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করেন হিন্দু তথা অন্যান্য সম্প্রদায়ের অনেকেই। এই বিশ্বাসে রামনবমী পুজার দিনে জন্মান্ধ শিশুদের আনা হয় এখানে।
হিন্দু সম্প্রদায় ছাড়াও অন্য সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ তাঁদের প্রতিবন্ধী সন্তানদের নিয়ে আসেন এই মন্দিরে। মানত করেন তাঁরা। কিংবদন্তি রয়েছে, প্রতিবন্ধীরা ভালো হয়ে ফিরেন এই রামমন্দির থেকে। যারা দৃষ্টি ফিরে পান, কথিত আছে তাঁরা প্রতিবছরই আসেন মানত করতে।
মন্দির কমিটির সভাপতি চন্দন কুমার মৈত্র বলেন, প্রতিবছর চৈত্র মাসে রামের জন্ম তিথিতে মন্দিরে বিশেষ পুজা-অর্চনার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ৯ দিন ধরে চলে এ পুজা-অর্চনা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ ভারত থেকেও আসেন হিন্দু পূণ্যার্থীরা। গঙ্গাস্নান করে তাঁরা পুজা দেন। সকল ধর্ম-বর্ণের লাখো মানুষের ঢল নামে এই উৎসবকে ঘিরে। কিন্তু আবাসন সংকটের কারণে দুরদুরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
তিনি আরও বলেন, করোনাকালিন পরিস্থিতিতে মন্দিরে সীমিত পরিসরে পূর্জা-অর্চনা করা হয়েছে। এ সময়ে ভক্ত-পূণ্যার্থীদের জন্য মন্দিরের দ্বার বন্ধ ছিল। এবারের পূজায় সবার জন্যই এটি উন্মুক্ত থাকবে। যাতে রামনবমীর উৎসব এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের সার্বজনীন উৎসব পরিণত হয়।