গাছ কেটে নগর উন্নয়ন, কংক্রিটের ‘শোভায়’ সবুজ বিলীন
রাজশাহী পুড়ছে তীব্র তাপে
স্টাফ রিপোর্টার: বাতাসে ক্ষতিকারক ধূলিকণা কমাতে বিশ্বের সেরা শহর রাজশাহী। সবুজায়ন ও নির্মল বাতাসের কারণে পদ্মাপাড়ের এই শহরকে বলা হয় গ্রিন সিটি। তবে সম্প্রতি নগর উন্নয়ন করতে গিয়ে গ্রিনসিটিকে পরিণত করা হয়েছে কংক্রিটের শহরে। নগরজুড়ে কংক্রিটের উন্নয়ন গিলে খাচ্ছে রাজশাহীর সবুজ! সড়ক উন্নয়নের নামে কেটে ফেলা হয়েছে হাজারো ছায়াদায়ী গাছ। প্রকাশ্যে চলছে পুকুর-জলাশয় ভরাটের মহোৎসব। গত এক দশকে রাজশাহী শহরের ৯৭ ভাগ পুকুর ভরাট হয়ে গেছে।
জানা গেছে, বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য এর মধ্যেই দুই হাজার ৬১৬টি ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সী ছায়াদায়ী গাছ কেটেছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। কোনো রকম পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই এসব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, হাজারো পুরনো গাছ নিধন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও পুকুর-জলাশয় ভরাটের কারণেই বৃদ্ধি পেয়েছে শহরের তাপমাত্রা। গতকাল মঙ্গলবার রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রকল্প বাস্তবায়নে আড়াই হাজারের বেশি গাছ কাটা পড়েছে। কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে একটি গাছ কাটলে তার পরিবর্তে কমপক্ষে তিনটি গাছ লাগানোর নিয়ম (বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন আইন ২০২২) আছে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, এমন আচরণ পরিবেশের সঙ্গে নিষ্ঠুর বর্বরতা ছাড়া কিছুই নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা পরিবেশের জন্য চরম হুমকি হতে পারে।
উন্নয়নের কাজ শুরুর আগে নগরীর সড়কগুলোর দুই পাশে ছিল বড় বড় সব গাছ। অনেক গাছ ছিল বেশ পুরনো। সড়কগুলো ছিল সবুজ টানেলের মতো। গাছের ছায়ায় সড়কে ছিল অন্যরকম শীতল অনুভূতি। কিন্তু বর্তমান চিত্র ভিন্ন। এখন নতুন নতুন রাস্তাগুলোর দুপাশ রীতিমতো খাঁ খাঁ করছে। বড় কোনো গাছের অস্তিত্ব আর চোখে পড়ে না। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা কিছু গাছ লাগিয়েছেন বললেও আদতে সেগুলো সৌন্দর্যবর্ধনের গাছ। ছায়া-শীতল করার জন্য এসব খুব বেশি ভূমিকা রাখবে না।
এদিকে, গত এক দশকে রাজশাহী শহরের ৯৭ ভাগ পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। শুধু গত বছরেই রাজশাহী নগরের অন্তত পাঁচটি পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। অথচ রাজশাহীর পুকুর-জলাশয় নিয়ে একটি রিটের আদেশে উচ্চ আদালত পুকুর রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আইনে থাকলেও পুকুর ভরাটে কোনো আইন প্রয়োগ হচ্ছে না। জলাশয় কমে যাওয়ায় ক্রমেই রাজশাহীতে তাপমাত্রা বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটলে জলাশয়–সংকটে বড় ধরনের বিপদের মুখোমুখি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. নূর ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, পুকুর ভরাট থামানো যাচ্ছে না। অনেকের ব্যক্তিগত পুকুর, সেগুলো বিক্রি করে দিচ্ছে। তাই তারা পুকুর রক্ষা করতে একটি প্রকল্প পাসের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন ২০১৯ সালে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা পাস হয়নি। কারণ, ব্যক্তিগত পুকুর রক্ষা করার একমাত্র উপায় পুকুর কিনে নেয়া।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, নগরীর অবকাঠামো উন্নয়নে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তিন হাজার কোটি টাকার তিন বছর মেয়াদি বড় প্রকল্প পায় রাসিক। এর পর সেটি বাস্তবায়নে পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই কাটা হয়েছে দুই হাজার ৬১৪টি গাছ।
এর মধ্যে নগরীর বন্ধ গেট থেকে সিটি হাট পর্যন্ত সড়ক উন্নয়নে কাটা হয়েছে ৮৮৭টি গাছ, তালাইমারী থেকে কাটাখালী পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে ৬২১টি, ভদ্রা থেকে নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল সড়ক উন্নয়নে ৪৯৮টি, পোস্টাল একাডেমি থেকে ম্যাচ ফ্যাক্টরি উন্নয়নে ১৬৩টি ও রাজশাহী-নওহাটা আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়নে কাটা পড়ে ৪৪৫টি গাছ।
পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই গাছ কাটার বিষয়টি স্বীকার করে সিটি করপোরেশন বলছে, বন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের অনুমতি নিয়ে গাছ কাটা হয়েছে। তবে বন অধিদপ্তর বলছে, তারা শুধু গাছের মূল্য নির্ধারণ করে, গাছ কাটার কোনো অনুমতি দেয় না। রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. নূর ইসলাম বলেন, আমাদের এ প্রকল্পটি আগামী জুলাই মাসেই শেষ হবে। কাজও শেষ পর্যায়ে। কিছু ফ্লাইওভার বাদে সব কাজই শেষ করেছি। এ প্রকল্প এখন রিভাইস ও দুই বছরের জন্য বাড়ানোর আবেদন পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, এ প্রকল্পের জন্য যে গাছ কাটা হয়েছে সেগুলো আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়েই কেটেছি। এছাড়া আমাদের পক্ষ থেকে শহরের বিভিন্ন অংশে ৪৪ হাজারেরও বেশি গাছ লাগানো হয়েছে। পাশাপাশি এ প্রকল্প শেষে সে সব অঞ্চলেও গাছ লাগানো হবে।
তবে রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রফিকুজ্জামান শাহ্ বলেন, কোনো গাছ কাটার দরকার পড়লে সেটি আমাদের জানানো হয়। আমরা শুধু গাছের দাম নির্ধারণ করে দিতে পারি। কে সেটি কাটবে বা রাখবে সেটি তারা করবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্পের নামে বৃক্ষ নিধন হুমকিতে ফেলবে রাজশাহী নগরীর পরিবেশ-প্রতিবেশ। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলার) সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল বলেন, উন্নয়ন প্রয়োজন আছে, কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি করে উন্নয়ন টেকসই হয় না। সিটি করপোরেশন যদি গাছগুলো রেখে প্রকল্পের কাজ করতো তাহলে ভালো হতো। যদি সেটি না হয় তবে যে এলাকায় কাজ হবে সেখানে তিন বছর বা তার আগে কিছু গাছ লাগিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে যেটা হয় আর কী, বাস্তবায়নের সময় পরিবেশের ধার ধরা হয় না।
পরিবেশকে বিরতিতে রেখেই তারা এটি বাস্তবায়ন করে। সেগুলোতে উন্নয়ন প্রকল্প যেমন টেকসই হয় না, তেমনি পরিবেশের ক্ষতি করে। খেয়াল করলে দেখবেন সারা দেশেই এবছর তাপমাত্রা বেড়েছে। আমাদের যে গাছগুলো আছে এগুলো যদি আমরা কেটে ফেলি তবে রাজশাহীর তাপমাত্রা আরও বড়বে। তাপমাত্রার কারণে হয়তো রাজশাহী বসবাস যোগ্যতা হারাবে। সেজন্য যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প করতে হলে এগুলো মাথায় রেখেই করতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহীর সভাপতি সফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ এসডিজি স্বাক্ষরকারী দেশ। টেকসই মানে আমাদের পূর্বপুরুষ যে প্রকৃতি রেখে গেছে তা কমাবো নয়। বরং বাড়াবো। উন্নয়ন হতে হবে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে রেখে। এটি ধ্বংস করে নয়। কিন্তু যখন আমরা উন্নয়ন করি তখন এটি কোনোভাবেই মানি না। আগামী প্রজন্মের কাছে ভয়াবহ অন্যায় করে এটি করা হচ্ছে।
সোনালী/জগদীশ রবিদাস