ঢাকা | নভেম্বর ২৫, ২০২৪ - ৫:৫৩ অপরাহ্ন

দিনে-রাতে মশায় অসহায় নগরজীবন

  • আপডেট: Wednesday, March 27, 2024 - 9:00 pm

কাজে আসছে না রাসিকের কার্যক্রম

জগদীশ রবিদাস: সারাদেশে ক্লিন সিটি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে রাজশাহী। সবুজে ঘেরা এ শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সিটি করপোরেশন। তবে শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিচ্ছন্ন শহরকে যেন নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে মশা। মশার অতিরিক্ত উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন পুরো নগরবাসী। শুধু সন্ধ্যা বা রাতই নয়, দিনের বেলাও মশারি টানিয়ে বা কয়েল জালিয়ে থাকতে হচ্ছে পদ্মা পাড়ের মানুষকে।

এতে শহরজুড়ে চালানো ‘পরিচ্ছন্নতা’র প্রকৃত কার্যকারীতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নাগরিক মহলে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত এবং নিয়মিত ওষুধ ছিটানো ও স্প্রে করার দাবি করা হলেও নগরবাসীর অভিযোগ, মশার উপদ্রব থেকে নাগরিকদের স্বস্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে করপোরেশন। যদিও মশা নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীকেই আরও বাড়তি সচেতন হওয়ার পরামর্শ সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্টদের।

করপোরেশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, মশা নিয়ন্ত্রণে সাধ্য অনুযায়ী তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট কোন সময় নয়, বরং মশা নিয়ন্ত্রণে বছরজুড়েই নানা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। উড়ন্ত মশা নিধনের জন্য ৩০টি ওয়ার্ডেই ফগার মেশিনের মাধ্যমে স্প্রে করা হয়। এ ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডের বিভিন্ন ড্রেনে নিয়মিত লার্ভিসাইড (লার্ভা মারার ওষুধ) ছিটানো হয়। ড্রেনগুলোও প্রতিনিয়ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়।

তবে নগরের মিয়াঁপাড়া, টিকাপাড়া, হড়গ্রাম বাজার, মোল্লাপাড়া, মহিষবাথান, ছোট বনগ্রাম, দড়িখরবোনা, মালদা কলোনী, শিল্পীপাড়া, মথুরডাঙা, সপুরা, দাশপুকুর, ভাটাপাড়া, কাদিরগঞ্জ, হেতেম খাঁ লিচু বাগান, পাঠানপাড়া, কয়েরদাঁড়া, সাধুর মোড়, মেহেরচন্ডী, বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন বাজার, তালাইমারী শহিদ মিনার, কাজলা, কেদুর মোড়, শিরোইল, সাহাজীপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার ভিতরের পাড়া-মহল্লাগুলো ঘুরে ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৫ দিনের বেশি সময় তারা এলাকায় ফগার মেশিনের শব্দ শুনতে পাননি।

কোন কোন এলাকায় ফগার মেশিনের কার্যক্রম দেখা গেলেও তা সীমিত ও নির্দিষ্ট স্থানে প্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, ফগার মেশিনে ঔষুধের পরিবর্তে কেরোসিন ব্যবহার করা হচ্ছে; এমন অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ। তাদের যুক্তি- ফগার মেশিনে যদি আসলেই কার্যকর কিছু ব্যবহিত হয়, তবে সেটি প্রয়োগের পরেও মশার এমন উপদ্রপ কেন?

ছুটির দিনগুলোয় শহরের টিঁ-বাঁধ, আইবাঁধ, মুক্তমঞ্চ, পদ্মা গার্ডেনসহ নদীর পাড়ে ভিড় করেন নগরবাসী। একটু প্রশস্তি পেতে নদীর কোল ঘেঁসে গড়ে ওঠা ওইসব পার্কে মশার কারণে সন্ধ্যার পর কেউ টিকতেই পারে না। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় মুক্তমঞ্চে পরিবার নিয়ে সময় কাটাতে গেছিলেন সাদেকুল ইসলাম। তিনি বলেন, নদীর পাড়ে যে কোন স্থানে একটু বসলেই যেন হাজার-হাজার মশা। কিছু কিনে খেতে গেলে তার মধ্যেও মশা বসছে। মশার অসহ্য যন্ত্রণায় সন্ধ্যার পর আর সেখানে থাকতে পারলাম না। মশা তাড়িয়ে তাড়িয়ে কতক্ষণ থাকা যায়! একটু বসামাত্রই মশা কামড়ে হাত-পা ফুলিয়ে ফেলেছে।

মহানগরীর ডাবতলা এলাকার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রফেসর গোলাম রসুল বলেন, মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ প্রায়। শহরের অনেক এলাকায় মশার জ্বালায় শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে পারছে না। শুধু রাত বা সন্ধ্যা নয়, দিনের বেলায়ও মশার উপদ্রবে মানুষ বিরক্ত। গরম এখনো পড়েনি। বর্ষার আগেই যদি মশার এমন বিস্তার হয়, বৃষ্টি শুরু হলে পরিস্থিতি কেমন হবে, তা নিয়ে আমি ব্যক্তিভাবেও চিন্তিত। মশা মারতে কয়েল, অ্যারোসল, মশা তাড়ানোর বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার করেও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। কালেভদ্রে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে মশার যে ওষুধ ছিটানো হয়, তা কার্যকর কিনা সেটি নিয়েও এমন প্রশ্ন আছে।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সিটি করপোরেশন তার সামর্থ অনুযায়ী সবটুকুই ঢেলে দিচ্ছে। রাসিকের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা সেলিম রেজা রঞ্জু বলেন, মশা কখনো নিধন করা যায় না, নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। উড়ন্ত মশা নিধনের জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডেই ফগার মেশিনের মাধ্যমে স্প্রে করা হয়। সব ওয়ার্ডের বিভিন্ন ড্রেনগুলোতে নিয়মিত লার্ভিসাইড (লার্ভা মারার ওষুধ) ছিটানো হয়। মশা যেন ডিম পাড়তে না পারে, সেজন্য ড্রেনগুলোও প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করা হয়। মশা নিয়ন্ত্রণ ও জনগণকে স্বস্তি দিতে আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা করে যাচ্ছি। মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য জনগণের সচেতনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণ একার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। জনগণ যতক্ষণ সচেতন হবে না, ততক্ষণ এর থেকে রেহাই পাওয়া কষ্টকর! জনগণ যদি সচেতন হয়, তারা যদি ড্রেনগুলোতে ময়লা না ফেলে, যত্রতত্র পানি জমতে না দেয়; তবেই মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

এদিকে কিটনাশক কেনার আগে করপোরেশনকে কীটতত্ত্ববিদের মতামত নেয়ার পরামর্শ দিয়ে সুসাশনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলার সভাপতি আহমেদ সফি উদ্দীন বলেন, আমরা অতিতে দেখেছি, মশা নিধনের কিটনাশক বা কেমিক্যাল কেনার আগে কীটতত্ত্ববিদদের মতামত নেয়া হতো। নানা কার্যক্রম চালানোর পরেও মশা নিধন না হওয়ার পেছনে কারণ হচ্ছে এটি সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট কোন এক্সপার্ট সিটি করপোরেশনে নেই। আমার জানা নেই, তারা যে কিটনাশক ব্যবহার করে তা ক্রয়ের আগে কোন বিষেশজ্ঞদের মতামত নেয়া হয়েছে কিনা। তকারা এটি যদি না করে থাকেন, তবে এটি অর্থের অপচয়ই শুধু নয়, নাগরিকদের প্রতি এক ধরনের নির্যাতন। মশা নিধন খুব কঠিন কাজ। কাজেই কোন ধরনের কিটনাশক এখানে ব্যবহার করতে হবে, সে বিষয়ে কার্যকর ধারণা না থাকলে কোন কার্যক্রমই কাজে আসবে না।

মশা নিধনের ক্ষেত্রে তিনিও জনগণের সচেতনতাকে গুরুত্ব দেন। বলেন, অবশ্যই আমাদের নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে। আমরা যদি সিটি করপোরেশনকে সহযোগিতা না করি, তবে তাদের একার পক্ষে সবকিছু সম্ভব নয়, এটিও সত্য। কিন্তু জনগণকে সচেতন করার দায়িত্বটাও সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে তাদের পক্ষ থেকে যদি প্রকল্প তাকে, বাজেট থাকে, তবে অবশ্যই মানুষকে সচেতন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদেরও ভূমিকা রাখতে হবে।

সোনালী/জেআর