নাটোরে ১০৫ কোটি টাকার গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা
নাটোর প্রতিনিধি: চলছে হেমন্তকাল। শীত মৌসুম আসতে এখনও বেশ কিছুদিন বাকি। এরই মধ্যে নাটোরের গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়েছে শীতের আমেজ। রাতে ঠান্ডা-হিমেল বায়ু আর সকালের শিশির ভেজা ঘাস-পাতাই জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে গাছিদের খেজুরের রস সংগ্রহের প্রস্তুতি।
পাশাপাশি চলছে খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরিকারী গাছিদের নিয়ে কর্মশালা। আর গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতীক মধু বৃক্ষ খেজুর গাছ পরিচর্যা-পরিষ্কারসহ রস সংগ্রহের উপযোগী করতে প্রতিদিন ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরাও। আর মাত্র কয়েকদিন পরেই পাওয়া যাবে মিষ্টি মধু সেই কাক্সিক্ষত খেজুরের রস। যার ঘ্রাণে মৌ মৌ হয়ে উঠবে পুরো এলাকার বাতাস। গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক উৎসব শুরু হবে খেজুরের মিষ্টি রসকে ঘিরে।
পুরো শীত মৌসুম জুড়ে চলবে সু-স্বাদে ভরা বিভিন্ন ধরনের পিঠা উৎসব। এছাড়া পায়েস-পুলিসহ নানা রকম খাওয়ার আয়োজন তো রয়েছেই। শীতের মৌসুমে খেজুরের রস ও গুড়সহ পিঠা খেতে শহর থেকে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে আসেন অনেকেই। শীতের সকালের রৌদ্রে খেজুরের রস ও মুড়ি খাওয়ার আসর বসে বাড়ির আঙিনায়। শীত মৌসুমে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে উৎসব মুখর পরিবেশে খেজুরের গুড় দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরির আয়োজন করা হয়। সেই প্রতীক্ষায় আছেন গ্রামের মানুষ।
নাটোর জেলার সব উপজেলাতেই খেজুর গাছ থাকলেও লালপুর উপজেলায় তুলনামূলক খেজুরের গাছের সংখ্যা ও গুড় উৎপাদন হয় সবচেয়ে বেশি। এরপরেই রয়েছে বড়াইগ্রাম উপজেলা। তবে বড়াইগ্রাম উপজেলায় খেজুরের গাছ ও গুড় উৎপাদনের পরিসংখ্যান নেই। এরপরও বড়াইগ্রামে খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরিকারী অর্ধশতাধিক গাছিদের নিয়ে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় কৃষি অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে উপজেলার বাহিমালীর ইনান গ্রুপের প্রধান কার্যালয় প্রাঙ্গণে এই কর্মশালার আয়োজন করে প্রাকৃতিক পুষ্টিযুক্ত মিষ্টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রুট বাংলাদেশ।
ইনান গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শারমিন সুলতানা, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মেজবাউল করিম, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার কর্মকার ও মজিবর রহমান, রুট বাংলাদেশের ফুড প্রডাকশন ম্যানেজার রানা হামিদ, মার্কেটিং ম্যানেজার রিপন আলী, স্থানীয় উদ্যোক্তা জাহিদুল ইসলাম, খেজুর গাছি হুজুর আলী প্রামাণিক প্রমুখ। এদিকে লালপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, দশটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা অঞ্চলে সড়ক ও রেললাইনের দুই পাশে, জমির আইল, বাড়ির আঙিনায় ছড়িয়ে আছে প্রায় ৩ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ খেজুরের গাছ। এসব গাছ থেকে গুড় সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৭৯ মেট্রিক টন। খেজুর গাছের রস সংগ্রহের ওপর প্রায় ৩ হাজার পরিবার নির্ভরশীল।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় মোট খেজুর গাছ রয়েছে ৬ লাখ ২৭ হাজার ৭৯০টি। এর মধ্যে রস সংগ্রহের উপযোগী গাছ রয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৬২২টি। শীত মৌসুমে ৭৫ দিনে প্রতিটি গাছ থেকে ১৭৪ কেজি রস পাওয়া যায়। আর প্রতিটি গাছের রসে গুড় উৎপাদন হয় ১৭ দশমিক ৪০ কেজি। জেলায় প্রতি মৌসুমে গড়ে প্রায় ৯ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন (৯৬ লাখ ২৩ হাজার ৮৬২ কেজি) খেজুর গুড় উৎপাদন হয়। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি বছর নাটোর জেলায় ১০৫ কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদন ও বাজারজাত হয়।
গত মৌসুমে প্রায় শত কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদন হয়েছে। অন্যদিকে উপজেলা পর্যায়ের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জেলার লালপুর উপজেলায় ৩ লাখ ১৪ হাজার ৫০০টি খেজুর গাছে প্রতি বছর গুড় উৎপাদন হয় প্রায় ৫ হাজার ৭৯ মেট্রিক টন, বড়াইগ্রাম উপজেলায় ১ লাখ ৬ হাজার গাছে গুড় উৎপাদন হয় ১ হাজার ৭১১ মেট্রিক টন, গুরুদাসপুর উপজেলায় ৭৫ হাজার ৯৪০ খেজুর গাছে গুড় উৎপাদন হয় ১ হাজার ৩২ মেট্রিক টন, সদর উপজেলায় ৪৪ হাজার গাছে ৫৯৮ মেট্রিক টন, নলডাঙ্গা উপজেলায় ৬ হাজার গাছে ৯১ দশমিক ৮ মেট্রিক টন, সিংড়া উপজেলায় ৬০ হাজার গাছে ৭৬৫ মেট্রিক টন ও বাগাতিপাড়া উপজেলায় ২১ হাজার ৩৫০টি গাছে গুড় উৎপাদন হয় ৩৪৪ মেট্রিক টন। জেলায় অন্তত ১০ হাজার মানুষ খেজুরের রস ও গুড় উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র ও স্থানীয়রা জানান, কেবল শীতকাল এলেই অযত্নে ও অবহেলায় বেড়ে ওঠা এই খেজুর গাছের কদর বাড়ে। খেজুরের গাছ অন্য কোনো ফসলের ক্ষতি করে না। এই গাছের জন্য বাড়তি কোনো খরচ গুনতে হয় না। ঝোপ জঙ্গলে কোনো প্রকার যত্ন ছাড়াই বেড়ে ওঠে খেজুর গাছ। শুধু শীত মৌসুম এলে নিয়মিত পরিষ্কার করে রস সংগ্রহ করতে হয়। খেজুর গাছ মিষ্টি রস দেয়। প্রতিদিন একজন গাছি প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করে থাকেন। একজন গাছি শীত মৌসুমে ৭০ থেকে ৭৫ দিনে একটি খেজুর গাছ থেকে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কেজি গুড় পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া খেজুরের পাতা দিয়ে মাদুর তৈরিসহ খেজুরের গাছ কেটে ঘরের তীর তৈরি করা হয়। এ বিষয়ে নলডাঙার বুড়ির ভাগ গ্রামের আহাদ আলী জানান, প্রতি বছর তিনি অন্তত ৭০ থেকে ৮০টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বাড়িতেই গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন। কোনো কোনো সময় বাড়ি থেকেও গুড় বিক্রি হয়।
হলুদঘর গ্রামের খলিলুর রহমান জানান, প্রতি বছর প্রায় ১০০টির মত গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন তিনি। গত বছরের তুলনায় এবার আরও ২০টি গাছ বেশি প্রস্তত করছেন। তিনি বলেন, শীতের সময় খেজুরের গুড় তৈরি ও বিক্রি করে তার সংসার ভালোই চলে। লালপুর এলাকার আলাল হোসেন, মঈফুল, মোজাফফর হোসেনসহ আরও অনেকে জানান, লালপুর এলাকার খেজুরের গুড় প্রসিদ্ধ। এখানকার গুড় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই বাজারজাত করা হয়।
কোনো কোনো সময় দেশের বাইরেও পাটালি গুড় পাঠানো হয়। তাদের দাবি, খেজুরের গুড়ের যেমন কদর আছে, সেই তুলনায় দাম আরও বেশি পাওয়া দরকার। কেননা উৎপাদন খরচ বেশি, পরিশ্রমও বেশি হয়। তাই এই গুড় বিক্রির একটি সঠিক প্লাটফর্ম তৈরি করা দরকার। লালপুর, বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, সদর ও নলডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খেজুরের গুড় ও রসের চাহিদা যেমন আছে। পাশাপাশি দামও ভালো পাওয়া যায়। তবে বাজার ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাত করা গেলে এই গুড় শুধু দেশে নয়, বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এজন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
লালপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রীতম কুমার হোড় বলেন, আমরা কৃষকদের খেজুরের গাছ লাগানোর জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকি। যা কৃষকদের রস ও গুড়ের চাহিদা মিটাবে। এ ছাড়া খেজুরের রস ও গুড় বিক্রি করে সংসারের আর্থিক সচ্ছলতা বয়ে আনবে। একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করে নলডাঙা উপজেলা কৃষি অফিসার ফৌজিয়া ফেরদৌস বলেন, একসময় খেজুরের গাছের সংখ্যা বেশি ছিল এবং গুড়ও উৎপাদন হত বেশি। আর খেজুরের গুড়ের চাহিদা সব সময় বেশি থাকে। কেননা এই গুড়ের স্বাদ একটু ভিন্ন ও মজাদার। পিঠা-পায়েস থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই খেজুরের গুড়ের ব্যবহার বেশি হয়।
এ ছাড়া খেজুরের রস দিয়ে সকালে মুড়ি খাওয়া, রস জ¦াল দিয়ে ভাপা পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। এজন্য খেজুরের রস ও গুড় আমাদের একটা ঐতিহ্যও বটে। কিন্তু কালের বিবর্তনে গাছের সংখ্যা অনেকটা কমে গেছে। তবে কৃষি বিভাগ থেকে খেজুর গাছ লাগানো ও পরিচর্যা করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বাঙালির এই ঐতিহ্য ধরে রাখাসহ অর্থনৈতিক সম্ভার ফিরিয়ে আনতে সবাইকে খেজুর গাছ লাগানোর প্রতি নজর দেয়া উচিত। সেই বিবেচনায় কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের পাশাপাশি এই বিষয়টির প্রতি কৃষি বিভাগ থেকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আবদুল ওয়াদুদ বলেন, খেজুরের রস ও গুড় দুটোই মানুষের কাছে খুব প্রিয় খাবার। খেজুরের রস ও গুড়কে ঘিরে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে জেলার মানুষ খেজুরের রস দিয়ে গুড় উৎপাদন করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তবে নিরাপদ গুড় উৎপাদন, সঠিকভাবে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে এ খাত লাভজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। এজন্য ভোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে, খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদনে গাছিদের সঠিক ধারণা দিতে হবে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগ সজাগ আছে এবং খেজুর গাছ রোপণে মানুষকে উৎসাহিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হবে।
সোনালী/জেআর