বগুড়ায় অভাবের যন্ত্রণা সইতে না পেরে মৃত্যুকে বেছে নিলেন দিনমজুর
অনলাইন ডেস্ক: ‘নিফুল প্রামাণিক এতটাই অভাবে ছিলেন বুঝতে পারিনি, আগে জানলে সবাই মিলে তাঁর পাশে দাঁড়াতাম। কাফনের কাপড় কেনার টাকাও তাঁর স্ত্রীর কাছে ছিল না।
আল্লাহ চেয়েছে তাই আমি নিফুলের শেষযাত্রার কাপড়টুকু কিনে দিতে পেরেছি। নিফুলের মৃত্যু এই সমাজের মুখে চপেটাঘাত। লজ্জিত হওয়ার পাশাপাশি অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।’
কথাগুলো বলছিলেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার দিগদাইড় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহাফুজ আলম সোহেল। অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা করা এ ইউনিয়নের উত্তর বাঁশহাটা গ্রামের নিফুল প্রামাণিকের (৩৪) প্রতিবেশী তিনি।
নিফুল গত শুক্রবার রাতে নিজঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিন সন্তানের বাবা নিফুল ওই গ্রামের মৃত আবদুল কাদেরের ছেলে। পেশায় তিনি দিনমজুর ছিলেন।
প্রায় দেড় বছর আগে নিফুলের ৯ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে বিপুল বাড়ির সামনে সড়কে অটোরিকশার চাপায় মারা যায়। এর পর থেকেই মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন নিফুল। ছেলের মৃত্যুর কিছুদিন পর তাঁর পায়ে ঘা হয়। এ জন্য আর দিনমজুরের কাজও করতে পারতেন না তিনি।
তাঁর স্ত্রী বিলকিস বেগম প্রতিবেশীদের বাড়িতে কাজ করতেন। কাজের বিনিময়ে যা পেতেন, তাই দিয়েই চলত সংসার। দিন দশেক আগে নিফুলের বড় মেয়ে নিপার সন্তান হয়। মেয়ের চিকিৎসার জন্যও টাকার প্রয়োজন ছিল নিফুলের। কিন্তু অসহায় নিফুলের পক্ষে টাকা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না।
এ নিয়েও নিফুল দুশ্চিন্তায় ছিলেন। অভাবের তাড়নায় হতাশায় শুক্রবার রাতে কোনো এক সময় তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। শনিবার সকালে তাঁর স্ত্রী বিলকিস স্বামীর ঝুলন্ত লাশ দেখতে পেয়ে প্রতিবেশীদের খবর দেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে।
শনিবার দুপুরে উত্তর বাঁশহাটা গ্রামে নিফুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দোচালা জরাজীর্ণ ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন নিফুল। দুটি কক্ষের ঘরের মধ্যে একটি ঘরে নিফুলের মরদেহ রাখা হয়েছে।
ঘরের বাইরে তাঁর চার বছর বয়সী শিশু নিমা ও পাঁচ মাস বয়সী শিশু নুসরাত প্রতিবেশীদের কোলে বসে বাবাকে দেখার জন্য ছটফট করছে। তাঁর স্ত্রী মাটিতে বসে স্বামীর জন্য বিলাপ করছেন। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবাই চোখ মুছছিলেন। কারণ
সবারই জানা, অভাবের তাড়নায় এই পরিবারের একমাত্র অবলম্বন নিফুল নিজের জীবনকে নিজ হাতেই শেষ করে দিয়েছেন।
নিফুলের প্রতিবেশী রিয়াজ উদ্দিন বলেন, তাঁর মতো অভাবি এই গ্রামে কেউ ছিলেন না। অসুস্থতা নিয়ে কোনো কাজ তিনি করতে পারতেন না।
এ ছাড়া পুত্র বিয়োগের শোক তাঁর মধ্যে আরও জেঁকে বসে। তারা এতটাই দরিদ্র যে, নিফুলের কাফন থেকে দাফন সব গ্রামের মানুষকেই করতে হবে।
দিগদাইড় ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য লাবলু মিয়া বলেন, নিফুল একজন ভালো মানুষ ছিলেন। কয়েক দিন আগেও তাঁর বড় মেয়ের সন্তান হওয়ার পর তাঁর (লাবলু) কাছে কিছু টাকা চেয়েছিলেন। তিনি সাধ্যমতো দিয়েছেন।
অভাবের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তিনি মৃত্যুকে বেছে নিলেন। এ মৃত্যু কারও জন্যই কাম্য নয়।
তিনি আরও বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাঁর স্ত্রীকে বিধবা ভাতাসহ যা যা সহযোগিতা করা সম্ভব, তা করা হবে।
নিফুলের স্ত্রী বিলকিস বেগম কান্না মেশানো কণ্ঠে বলেন, ছেলে চলে গেছে, স্বামীও গেলেন। ছোট ছোট দুই মেয়ে। কীভাবে তাদের বড় করবেন, সেই দুশ্চিন্তায় তিনি দিশেহারা। নিফুলেরই বা কি
দোষ? এত অভাব, কষ্ট নিয়ে কেউ টিকতে পারে না। এর পরও মানুষটা তো ছিল। এখন আর তাও নেই। সব শেষ হয়ে গেল। এ কথা বলে বিলাপ করতে থাকেন বিলকিস।
স্থানীয় সোনাতলা থানার উপপরিদর্শক ইমরান হোসেন বলেন, পারিবারিক নানা সমস্যার কারণে ওই ব্যক্তি (নিফুল) আত্মহত্যা করেছেন বলে তিনি জেনেছেন।
সোনালী/জেআর