ঢাকা | নভেম্বর ২১, ২০২৪ - ৭:২৯ অপরাহ্ন

ডিজিটাল বাংলাদেশের নয়া বাস্তবতা

  • আপডেট: Monday, June 26, 2023 - 12:22 pm

অনলাইন ডেস্ক: দেড় দশক আগে, নির্দিষ্টভাবে বললে ২০০৯ সালেও ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কথাটি রূপকথার মতো লাগত। এক পর্যায়ে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রাজনৈতিক স্লোগানে রূপান্তরিত হলো।

কেউ ঠাওরালেন, এটা কথার কথা। আবার অন্ধের হাতি দেখার মতো এর তাৎপর্য নিয়ে নানা মুনির নানা মত বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল– ব্রডব্যান্ড, ইন্টারনেট, মোবাইল, ফেসবুক, থ্রি জি ইত্যাদি। ২০২৩ সালে এসে ডিজিটাল বাংলাদেশ এক বাস্তবতা, যদিও বেকসুর বিড়ম্বনা কিংবা বাধামুক্ত নয়।

দুই.

‘ডিজিটাল অর্থনীতি: আমরা এগোচ্ছি’ শিরোনামে বিশ্লেষণধর্মী একটা নিবন্ধ লিখেছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক। লিখেছেন নিঝুম দ্বীপে বসে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির পিঠে চড়ে। প্রযুক্তিকে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের সহায়ক হিসেবে দেখার জন্যই ‘ডিজিটাল অর্থনীতি’র আবির্ভাব বলে তাঁর ধারণা। এই অর্থনীতিবিদ কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে দেশের বর্তমান প্রযুক্তিগত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নিয়েছেন।

অনুমান করতে কষ্ট হয় না, তলে তলে বেলা বয়ে যাওয়ার মতোই ধীরে ধীরে ডিজিটাল দুনিয়ার গহিনে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশ ঘটছে। যেমন ২০২২ সালে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। অথচ ২০০০ সালে সেই সংখ্যা ছিল মাত্র এক লাখ। অর্থাৎ মোট জনগণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখন ইন্টারনেটের সুযোগ পাচ্ছে এবং তা বাড়ছে প্রতি বছর প্রায় ১২ শতাংশ হারে। ২০২৩ সালে এসে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাত কোটি ছুঁইছুঁই, যা মোট জনগণের ৩৮ শতাংশ! অবাক করে দেওয়ার মতোই ঘটনা! নিবন্ধকার বলছেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশে এই প্রবৃদ্ধির হার অসম্ভব কল্পনামাত্র। প্রযুক্তিকে আপামর জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত।’

শুধু কি তাই? এই মুহূর্তে বাংলাদেশে রয়েছে সাড়ে চার কোটি সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী, যা মোট জনগণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। আর তাদের মধ্যে চার কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী। অর্থাৎ আগের দশকের অবকাঠামো এখন নিখাদ চাহিদায় রূপান্তরিত হয়েছে বলে ধারণা করা চলে। প্রযুক্তি এখন আর ফ্যাশন নয়, রীতিমতো প্যাশন। এ দিয়ে কিছু করার বাসনা সবার মনে; রিকশাওয়ালা থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত। এনামুল হক লিখেছেন, করোনার অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে যেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছিল মন্দা; পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই যেখানে প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল ঋণাত্মক, সেখানে বাংলাদেশে তা ছিল ব্যতিক্রম। কীভাবে সম্ভব হলো? মূলত তা ছিল ডিজিটাল বাজারের ফল। সাধারণ ডিজিটাল বাজার নয়। এক ব্যতিক্রমধর্মী বাজার। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী নিরক্ষর থাকা সত্ত্বেও ফেসবুক-লাইভ দিয়ে ক্রেতা আকৃষ্ট করার যে সুযোগ আমাদের ফেসবুকাররা তৈরি করেছিল, তা ছিল বিশ্বের জন্য বিস্ময়।

তিন.

বাজার প্রসঙ্গ উঠতেই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের ডিজিটাল বাজারটা কত বড়? কারণ ডিজিটাল অর্থনীতির বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা বুঝতে এর গতি-প্রকৃতি জানতে কিছু তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। অন্ধের হাতি দেখার মতো নয়; হতে হবে পরিসংখ্যানভিত্তিক। এনামুল হকের মতে, মোবাইল ফোনে কথা বলায় দেশে প্রায় ১৪৭ কোটি ডলার আয় হবে এবং তা ধীরে ধীরে কমে ২০২৭ সাল নাগাদ ১২৬ কোটিতে নামবে। তবে স্মার্ট ফোনের বাজার বর্তমানের ৫৮৬ কোটি ডলার থেকে একই সময়ে দাঁড়াবে ৭৫৪ কোটি ডলারে; গড় প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৯ শতাংশ। তার মানে, ফোন এখন শুধু কথা বলা নয়; মাধ্যম অনেক কাজ করার। যেমন সবচেয়ে কম শিক্ষিত জনগণের বিশাল অংশ এখন টিকটকার। আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক, এরা টিকটকের মাধ্যমে আয় করে, সেলিব্রিটি হয় এবং অন্যদের প্রভাবিত করে। নিবন্ধকার অর্থনীতিবিদ বলছেন, ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসারে চাই মোবাইল ফোন তৈরির নীতি। কপি নয়, দরকার দেশীয় মোবাইল ফোন, প্রয়োজন গবেষণাগার ও পরিবর্তিত করনীতি।

সফটওয়্যারের বাজারের আকৃতি প্রায় ৯২ কোটি ডলার এবং বছরে ১১ শতাংশ হারে বেড়ে ২০২৭ সালে দাঁড়াবে ১৪০ কোটি ডলারে, যার ৪০ শতাংশ হবে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার বাজার। হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশি সফটওয়্যার দেশে তৈরি করে বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে হবে। প্রয়োজন হবে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও ভারতের আদলে নীতি।

বর্তমানে বছরে প্রায় ১৫৮ কোটি ডলারের আইটি সেবার বাজার রয়েছে এবং ৯ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২৭ সালে দাঁড়াবে ২২৫ কোটি ডলারে। বিশ্ববাজার যেখানে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটির, আমাদের হিস্যা অতি নগণ্য। ক্লাউড পরিষেবা বাজার, সাইবার সুরক্ষা বাজার, আইওটি বাজার, মোবাইল ডাটা বাজার, ডাটা সেন্টার বাজার– সব মিলে ৫-৬শ কোটি ডলারের বাজার বর্তমান বাংলাদেশে। কিন্তু এটা বৈশ্বিক চাহিদার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। এই ডিজিটাল অর্থনীতি বেগবান ও শক্তিশালী করতে চাই ডিজিটাল অর্থনীতির বাজার ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন; একে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে উন্নীত করা। সেবার মান সৃষ্টি, মান নিয়ন্ত্রণ এবং ক্রেতাস্বার্থ সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দেওয়ার দায় সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেরই।

চার.

বর্তমান বাজারকে প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে উন্নীত করা কীভাবে সম্ভব? প্রথমত, দক্ষ কর্মী সৃষ্টি করতে প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন সনদের বাংলাদেশীকরণ। বিনিময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বিশাল জনগোষ্ঠীর সেবা বিক্রয়ে সক্ষমতা অর্জন। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল বাজার নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে বাজারটি প্রতিযোগিতামূলক করা। অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ বৃহৎ-বান্ধব, কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রসারে প্রতিবন্ধক। মনে রাখতে হবে, বাজার পরিপক্ব বা পরিপূর্ণ হওয়ার আগেই সরকারি নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণ আত্মঘাতী। তৃতীয়ত, প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন সাপেক্ষে দেশের জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য সুরক্ষিত করা। ডিজিটাল সেবা-পরিষেবা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে কর্মসংস্থানের পথ সুগম করা। চতুর্থত, কর ব্যবস্থা ডিজিটাল অর্থনীতির আলোকে ঢেলে সাজানো। পঞ্চমত, নিয়ন্ত্রণ হতে হবে গঠন ও গবেষণামূলক; অনুমানভিত্তিক নয়।

পাদটীকা

ফ্রিল্যান্সিং করে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কেউ আবার বিদেশের কাজ ঘরে বসে করে প্রচুর আয় করছে; সে গল্প না হয় অন্যদিন করা যাবে। এখন অন্য গল্প।

এক গৃহিণী সম্ভাব্য নারী গৃহকর্মীর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। কাজের ভার সম্পর্কে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে তিনি মেয়েটির কাছে প্রত্যাশিত বেতন সম্পর্কে প্রশ্ন রাখলেন। গৃহিণী ভেবেছিলেন, ৯-১০ হাজার তো হবেই, বিশেষত বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে। সম্ভাব্য গৃহকর্মী সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গৃহিণীর দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। গৃহিণী বললেন, ঠিক আছে। বুঝতে পারছি, বলার দরকার নেই। আমরা আপনাকে ভালো বেতন দেব। বলুন, কবে থেকে কাজে যোগ দেবেন এবং ছুটি কিংবা অন্য কোনো দাবি-দাওয়া কী?

মেয়েটি নড়েচড়ে বসে তার নীরবতা ভেঙে বলল, ‘খালাম্মা, আপনার বাসায় ওয়াইফাই আছে?’

আব্দুল বায়েস: অর্থনীতিবিদ; সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সোনালী/জেআর