সমকালীন প্রসঙ্গ || যোগ্য নেতাকর্মী তৈরির দায়িত্ব কার?
ভাস্কর রাসা
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালিত হবে জনগণের প্রত্যক্ষ মতের ভিত্তিতে। নির্বাচন কমিশন বা ইসি সম্মানিত নাগরিকদের মতামত গ্রহণ করবে। নাগরিকদের মতপ্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভোট। এই ভোট ব্যবস্থার আয়োজন, গ্রহণ, ভোট গণনা, ফল প্রকাশ করার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
কমিশন এ দায়িত্ব পালন করে বেশ কিছু নীতিমালা ও পদ্ধতি মেনে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনকালীন অনেক ক্ষমতাও দিয়েছে রাষ্ট্র। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কমিশন সরকারের কাছে যে কোনো সহায়তা চাইতে পারে এবং সরকার তা দিতে বাধ্য। অতএব ইসি নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকলেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা যায়।
জাতীয় নির্বাচনের এখনও সাত-আট মাস বাকি। এখনই মাঠ পর্যায়ে নাগরিকদের ভোট প্রদান বিষয়ে সচেতন করে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এসব পদক্ষেপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নাগরিকদের ভূমিকা ও দায়িত্ব সম্পর্কে প্রচারপত্র বিলি করা।
এ প্রচারপত্রে থাকবে ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে গণপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভুল করলে নাগরিক সমাজ কী কী ক্ষতির সম্মুখীন হবে এবং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানে নাগরিকদের গুরুত্ব সর্বাধিক– এ বিবেচনায় তাদের সচেতন করতে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে নাগরিক সমাবেশের আয়োজন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাদের ভূমিকা তুলে ধরে নির্বাচন কর্মকর্তার বক্তব্য প্রদান এবং নাগরিকদের মতামত গ্রহণ করা।
এসব সমাবেশে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রশাসনিক প্রচারপত্র বিলি করা। নির্বাচন কমিশনাররা সারাদেশে এসব নাগরিক সমাবেশ যথাযথভাবে হচ্ছে কিনা, তা তদারক করবেন এবং তা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত চালু রাখবেন। এমনকি নির্বাচন কমিশনারের উদ্যোগে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমাবেশ করে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রার্থীদের অঙ্গীকারও নেওয়া যায়।
উল্লিখিত প্রক্রিয়াগুলো সঠিকভাবে মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পারলে জনগণ জাতীয় দায়িত্ব পালন ও ভোটাধিকার প্রয়োগে উৎসাহিত হবে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য নিয়ে ভোটারের বাড়ি বাড়ি যাবে– এটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক দলগুলো ভোটকেন্দ্রে তাদের সমর্থিত ভোটারদের আনতে যারপরনাই চেষ্টা চালিয়ে যাবে। ফলে দু’দিক থেকে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে কর্মসূচি চলবে।
আরেকটি প্রশ্ন সামনে আসে– ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা। আমরা দেখেছি ভোটকেন্দ্রের কাছেই মারামারি শুরু হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ গ্রহণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতার কারণে বিলম্ব হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আইনি সীমাবদ্ধতাও এ বিলম্বের কারণ। একটি ক্ষুদ্র ঘটনাকে এ সুযোগে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সংঘাতের রূপ দিয়ে আশপাশে ছড়িয়ে দেয়। এ জন্য কড়া নজরদারি থাকবে যেন ভোটকেন্দ্র থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকে জনগণ। যারা ভোট দেবে তারাই শুধু দূরত্ব অতিক্রম করতে পারবে।
সংক্ষেপে বলা যায়, সারাবছর দেশব্যাপী নির্বাচন, ভোট প্রদান, প্রতিনিধি নির্বাচনে নাগরিকদের দায়িত্ববোধ, উন্নয়ন, সমাজের শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নাগরিক মতামতের গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে স্কুলিং করা নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি।
আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। আমাদের নির্বাচন নিয়ে তো আমাদেরই মাথাব্যথা থাকার কথা। অথচ নির্বাচনকালীন বিদেশিদের ভূমিকা প্রায় অভিভাবকের মতো, যা একটি স্বাধীন দেশের জন্য অসম্মানজনক। বিদেশে নির্বাচনের সময় তো আমাদের দেশের কূটনীতিকরা তাদের নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন– এমন সংবাদ কখনও শুনিনি।
এই নির্বাচনী অভিভাবকত্বের কারণ কী? সাধারণ ধারণায় বলা যায়, তারা বড় দেশ, বড় অর্থনৈতিক শক্তি। বড় সামরিক শক্তির কারণে ছোট দেশগুলোর ওপর তারা অভিভাবকত্ব চালায়। সেই সঙ্গে আমাদের দেশের বড় ও মাঝারি মাপের কিছু রাজনৈতিক দল নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধানের পথ না খুঁজে মোড়লদের ভূমিকায় থাকা বড় দেশগুলোর কাছে নালিশ করে তাদের দৈন্যই প্রকাশ করে যাচ্ছে।
নাগরিক অধিকার প্রয়োগ, অর্থাৎ ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে নাগরিক মানসিকতা গঠনে নির্বাচন কমিশন পরিকল্পিত প্রচারকার্য চালালে, তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বছরব্যাপী ধারাবাহিক স্কুলিং করলে জনগণ ভোট প্রয়োগে সচেতন হবে। এই প্রক্রিয়ার বিকল্প নেই।
মনে রাখতে হবে, মা সন্তানকে খাদ্য গ্রহণ শিখিয়ে দেয় বা সন্তান তা মায়ের কাছ থেকে শিখে নেয়। শিক্ষা ছাড়া কোনো কিছুই অর্জন করা যায় না। অথচ সমাজের সবচেয়ে বড় পরিচালনা শক্তি রাজনীতি হলেও এ রকম একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষণে কোনো স্কুলিং নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নিজ নিজ দলে রাজনৈতিক স্কুলিং কর্মসূচি চালু করা এবং তা একটি সিলেবাস আকারে হতে পারে।
প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সিলেবাসের সময় এক বছর করে। তিন বছর ধারাবাহিক রাজনৈতিক স্কুলিংয়ে পাঠ গ্রহণের পর সেই কর্মী, নেতা ও সংগঠক হবেন রাজনৈতিক আদর্শের পরীক্ষিত ব্যক্তি। তখন এই রাজনৈতিক ব্যক্তির মধ্যে একটি রাজনৈতিক স্বপ্ন তৈরি হবে। সেই স্বপ্ন হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন। এ স্বপ্নই তৈরি করবে ভবিষ্যৎ সমাজের ছবি। তিনি তাঁর হৃদয়পটে একটি সমাজচিত্র অঙ্কন করবেন।
অর্থাৎ রাজনীতিবিদ হচ্ছেন সমাজ পরিবর্তনের একজন শিল্পী। উল্লিখিত ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায়, রাজনীতি হচ্ছে সবচেয়ে গতিশীল শিল্পকলা। গতিশীল এ কারণে যে, রাজনীতি সামগ্রিক সমাজ ও তার বহুমাত্রিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তির সুযোগ নেই।
কিন্তু এখন রাজনৈতিক শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। ফলে দলে নেতা তৈরি হচ্ছে না। নেতা হচ্ছে পরিবার থেকে, ব্যবসায়ী থেকে, সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা থেকে। এর ফলে সমাজ আলোকিত হচ্ছে না। ব্যক্তিগত বিষয়-সম্পদ হচ্ছে নেতার লক্ষ্য। উন্নততর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সমাজ।
ধর্মান্ধতা, ছিদ্রান্বেষণ, দাম্ভিকতা, আদর্শহীনতা, স্বার্থান্ধতায় সমাজ ঘুরপাক খাচ্ছে। এই ভয়াবহতা থেকে উদ্ধার করতে পারে রাজনৈতিক স্কুলিং ব্যবস্থা। জাতীয় জীবনে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনকারী রাজনৈতিক দলকে এটা শুরু করা উচিত।
সারাদেশে অনলাইনের মাধ্যমে সহজে পলিটিক্যাল স্কুলিং চালু করা যায়। এ প্রক্রিয়ায় নেতাকর্মী, সংগঠক তৈরির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে যোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
ভাস্কর রাসা: ভাস্কর্য শিল্পী
সোনালী/জেআর