ঢাকা | নভেম্বর ২৬, ২০২৪ - ১:২১ পূর্বাহ্ন

দিনভর সন্ত্রাসী তাণ্ডব চললেও যায়নি পুলিশ

  • আপডেট: Sunday, March 20, 2022 - 9:23 pm

 

স্টাফ রিপোর্টার: তিনটি বসতবাড়ি ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে স্কেভেটর যন্ত্র দিয়ে বাড়ি তিনটির ১১টি ঘর একেবারে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির চারপাশে থাকা গাছগুলো কেটে ফেলে হয়েছে। প্রকাশ্যে লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গরু, ছাগল আর ইট। গত ৬ মার্চ দিনভর এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলেছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বসন্তপুর গ্রামে।

এই সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় ফোন করা হয়েছে। কিন্তু সাড়া মেলেনি। তাই ফোন করা হয়েছে পুলিশের জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বরে। তাও সাড়া মেলেনি। তাই প্রভাবশালী প্রতিপক্ষরা বাড়িগুলো উচ্ছেদ করে ফেলেছেন। পরিবার তিনটি নিজেদের সবকিছুই হারিয়েছেন। এখন এই পরিবারের সদস্যদের চোখের পানি শুকাচ্ছে না।

বসন্তপুর গ্রামে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক সংলগ্ন ২৪ কাঠা এই জমিটি ৪০ বছর আগে ১২ হাজার টাকায় কিনেছিলেন জালাল উদ্দিন (৭০) নামের এক ব্যক্তি। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর গাহানু সর্দার ও তাঁর দুই ভাতিজি পদ্মাবতী এবং যশবতী জমিটি বিক্রি করেছিলেন। এ সংক্রান্ত একটি কাগজ আছে জালালের। কিন্তু জমিটি রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার আগেই গাহানু মারা যান।

জালাল উদ্দিন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নিয়মিত ট্যাক্স দিয়ে জমিটিতে বাস করছিলেন। পরে তাঁর ছেলে শহিদুল ইসলাম ও মাহাবুর রহমানও জমিটিতে আলাদা বাড়ি করেন। এত দিন কোন সমস্যা হয়নি। হঠাৎ কিছু দিন আগে থেকে জমির মালিকানা দাবি করেন গাহানু সর্দারের ছেলে জোহর লাল ও মোহর লাল। জমি দখলকারী একটি চক্রকে সাথে নিয়ে তারা এই তিনটি পরিবারকে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করেছেন।

গত শুক্রবার বিকালে বসন্তপুরে গিয়ে দেখা যায়, তিনটি বাড়ির ১১টি ঘরের কোন চিহ্ন নেই। জমিটির একাংশে ছোট্ট একটিন জলাধার আছে। সেখানে পড়ে থাকতে দেখা গেছে লেপ, কাথা, ভাঙা হাড়িসহ সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। অভিযানের দিন পরিবারগুলোকে এসবও সরিয়ে নিতে দেওয়া হয়নি। সেদিনের বেশকিছু ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, আগুন লাগিয়ে স্কেভেটর যন্ত্র দিয়ে সবকিছু গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। জালালের কিছু ইট কেনা ছিল। সেই ইটগুলোও তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ট্রলিতে।

বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদের পর তিন পরিবারের ১৬ জন সদস্য আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। বসন্তপুর মোড়ে গিয়ে পাওয়া যায় বৃদ্ধ জালালকে। তিনি জানালেন, শুধু ইট নয়, একটি গরু, একটি ছাগলসহ বাড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গেছে সন্ত্রাসী বাহিনী। উচ্ছেদের সময় তাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র ছিল। ভয়ে কেউ প্রতিবাদের সাহস পায়নি। ঘটনার সময় থানায় এবং ৯৯৯ এ ফোন করা হলেও পুলিশ আসেনি। তবে আগুনের খবর পেয়ে এসেছিল ফায়ার সার্ভিস। মহাসড়ক থেকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িকেও নামতে দেওয়া হয়নি। পরে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ফিরে গেছে আগুন না নিভিয়ে।

জালাল জানালেন, ৩৬ বছর ধরে তারা এ জমিতে বাস করলেও কেউ মালিকানা দাবি করেনি। কিছু দিন আগে হঠাৎ জোহর লাল ও মোহর লাল মালিকানা দাবি করেন। জমির দখলে নিতে তারা মাটিকাটা ইউপির সদস্য সেতাফুর রহমান বাবু ও নয়ন ডাক্তার নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে হাত মেলান। তারা পুলিশকে ম্যানেজ করেন। তারপর ইউপি সদস্য বাবু এবং নয়ন ডাক্তারের নেতৃত্বেই উচ্ছেদ অভিযান চলে। তারা অন্তত ৫০ জন বহিরাগত সন্ত্রাসীকে ভাড়া করে এনে এ উচ্ছেদ চালান।

প্রথম দিন ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়ার পরও তারা ভিটা ছেড়ে আসেননি। পলিথিন টাঙিয়ে সেখানে রাত কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু পরদিন আবারও সন্ত্রাসী বাহিনী গিয়ে তাদের উচ্ছেদ করে। এ ঘটনায় তারা মামলা করার জন্য গোদাগাড়ী থানায় গেলেও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম মামলা তো নেননি; বরং দুর্ব্যবহার করেন। পরে তারা আদালতে মামলা করেছেন। কথা বলার সময় জালালের দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল পানি।

কথা বলার জন্য ইউপি সদস্য সেতাফুর রহমান বাবুকে ফোন করা হলে ধরেননি। অভিযুক্ত নয়ন বলেন, ‘কেউ কারও জমি দখলে নিতে পারে? জালালের তো কোন কাগজপত্র নাই। যাদের জমি তারা দখলে নিয়েছে।’ মাটিকাটা ইউপি চেয়ারম্যান সোহেল রানা বলেন, ‘আমি ঘটনাটা জানি। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী পরিবার আমার কাছে অভিযোগ করেছে।’ তিনি বলেন, ‘কারও জমির কাগজ না থাকলেও এভাবে কেউ উচ্ছেদ করতে পারে না। উচ্ছেদ করতে হলে আইনগতভাবেই করতে হবে। কিন্তু যেভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে সেটা অন্যায়। স্থানীয় লোকজন বলছেন যে, বার বার ফোন করা হলেও ঘটনার সময় পুলিশও আসেনি। আর পুলিশ বলছে, সবকিছুই নাকি ওপরের নির্দেশে হয়েছে।’

ছুটিতে থাকায় এ বিষয়ে গোদাগাড়ী থানার ওসি কামরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তবে থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম দাবি করেন, ঘটনার দিন উপ-পরিদর্শক আজিজুর রহমান ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন এবং ফিরে এসে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। তবে আজিজুর রহমান বলেছেন, ঘটনার দিন তিনি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাই ভাঙচুরের কাছে যেতে পারেননি। পরদিন তিনি সেখানে গেছেন। তিনি বলেন, ‘জমি নিয়ে এই দ্বন্দ্বটা আমাদের দৃষ্টিতে এলে আদালতে মামলা করে আইনগতভাবে দখলে নিতে বলেছিলাম। কিন্তু উচ্ছেদ করেছে তারা মামলা করেনি।’