কমেছে আমদানি-রপ্তানি
অনলাইন ডেস্ক: সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে কমেছে আমদানি-রপ্তানি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ডলার ক্রাইসিস এবং ব্যাংকের এলসি খোলায় অনীহা এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবহারকারীসহ ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা।
সূত্র জানিয়েছে, দেশে আমদানি রপ্তানির পরিমাণ কমছে। বৈশ্বিক সংকটের ধাক্কা লাগতে শুরু করেছে দেশের রপ্তানি খাতে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের বাজারে ইতোমধ্যে ধস নেমেছে বিশ্ববাজারে। শত শত কোটি টাকার তৈরি পোশাক আটকা পড়েছে বিভিন্ন কারখানার গুদামে। বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার দিয়েও পণ্য নিচ্ছেন না। কেউ কেউ অর্ডার স্থগিত করেছেন, কেউবা বাতিল। এতে করে রপ্তানির বাজারে বেশ সংকট তৈরি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম বন্দরে গেল অক্টোবরে আমদানি পণ্যের কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৯৭ হাজার ৫৩৮ টিইইউস, সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ১ হাজার ৪৯৩ টিইইউস এবং আগস্টে ১ লাখ ১৪ হাজার ৯২০ টিইইউস। অর্থাৎ চলতি বছরের আগস্টের তুলনায় গেল দুই মাসে ১৭ হাজার ৩৮২ টিইইউস আমদানি কনটেইনার কম হ্যান্ডলিং হয়েছে।
অন্যদিকে, গেল অক্টোবরে চট্টগ্রাম বন্দর রপ্তানি পণ্যের কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে ৫৯ হাজার ৩৩১ টিইইউস। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে ৬৩ হাজার ৮০৩ টিইইউস এবং আগস্টে ৭৫ হাজার ৬৯৭ টিইইউস রপ্তানি পণ্যের কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে। অর্থাৎ চলতি বছরের আগস্টের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দর গেল দুই মাসে রপ্তানি কনটেইনার কম হ্যান্ডলিং করেছে ১৬ হাজার ৩৬৬ টিইইউস।
২০২১ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম বন্দর আমদানি পণ্যের কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৫৯ টিইইউস। যা এবছরের অক্টোবরে ছিল ৯৭ হাজার ৫৩৮ টিইইউস। অর্থাৎ গতবছরের অক্টোবরের তুলনায় এবছরে একই সময়ে ২৭ হাজার ১২১ টিইইউস কনটেইনার পণ্য কম আমদানি হয়েছে।
অন্যদিকে ২০২১ সালের অক্টোবরে রপ্তানি হয়েছিল ৭০ হাজার ২৭০ টিইইউস কনটেইনার পণ্য। যা এবছরের অক্টোবরে ছিল ৫৯ হাজার ৩৩১ টিইইউস। গতবছরের অক্টোবরের তুলনায় এবছরে একই সময়ে ১০ হাজার ৯৩৯ টিইইউস কনটেইনার পণ্য কম রপ্তানি হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে মোট ১ হাজার ৬৮৫ কোটি ৩৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় তা প্রায় ১১০ কোটি ৪০ লাখ ডলার বেশি; মোট রপ্তানি হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ৫৭৪ কোটি ৯৪ লাখ ডলার। এ সময়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৭৪২ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরে সরকার ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আর গত ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানি হয়েছিল।
বিজিএমইএ’র তথ্যমতে, চট্টগ্রামে তালিকাভুক্ত ৭৬টি কারখানা রয়েছে। এ তালিকার বাইরে আরও ১৭৪টি কারখানা উৎপাদনে আছে। এর পাশাপাশি প্রায় ২শ ছোট কারখানা বড় বড় পোশাক কারখানার সঙ্গে চুক্তিতে কাজ করছে। সবমিলিয়ে চট্টগ্রামে বর্তমানে সাড়ে ৪শ’টির মত কারখানা সচল রয়েছে। গত তিন মাসে এসব কারখানায় ৪০ ভাগ কার্যাদেশ কমে গেছে। চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে সবমিলিয়ে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার কার্যাদেশ আসার কথা থাকলেও বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার কার্যাদেশ কমে গেছে।
বিজিএমইএ বলছে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও বিদ্যুৎ সমস্যা প্রকট হওয়ার পর থেকে রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে। এমনিতেই কার্যাদেশ কম, তার উপর বায়াররা (ক্রেতারা) যদি জানতে পারে বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটের প্রভাব পোশাক কারখানাগুলোতেও পড়েছে। তাহলে বায়াররা মুখ ফিরিয়ে নেবে। এতে করে আরও সংকটে পড়বে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাক শিল্প। তাই সবার আগে দ্র্রুত জ্বালানির ব্যবস্থা করে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের দাবি পোশাক মালিকদের এ সংগঠনটির।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমে যাওয়ায় অনেক কারখানা মালিকরা যথাসময়ে শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি হবার আশঙ্কার কথা রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ৩৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ বাড়িয়েছে ডিপো মালিকরা। বর্তমানে ২০ ফুট সাইজের কনটেইনারে ইমপোর্ট হ্যান্ডেলিং প্যাকেজে ৩ হাজার ৩২৬ টাকা বাড়িয়ে ১২ হাজার ৮৩০ টাকা এবং ৪০ ফুট সাইজের কনটেইনারে ৩ হাজার ৮৫২ টাকা বাডিয়ে ১৪ হাজার ৮৫৭ টাকা আদায় করা হচ্ছে। এতে করে ব্যয় বাড়লেও বাড়তি দাম পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ব্যবসায়ীরা কম পণ্য আনা নেয়া করায় চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং চিত্রে এই তারতম্য উঠে এসেছে। তবে চট্টগ্রাম বন্দর ৩ মিলিয়নের বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বন্দর। অর্থাৎ সাময়িক মন্দা কেটে গিয়ে বেশি পরিমাণ আমদানি-রপ্তানি কনটেইনার বেড়ে গেলেও তা চট্টগ্রাম বন্দর হ্যান্ডলিয়ে প্রস্তুত আছে। আর ব্যবসায় ওঠানামা একটি সাধারণ বিষয়। গত দুইমাস কমলেও আমার সামনে হয়তো বেড়ে গিয়ে এই ঘাটতিটা পূরণ করে দিবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নঈম উদ্দিন হাছান আওরঙ্গজেব চৌধুরী বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে যে সংকট তৈরি হয়েছে সেটা মূলত রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে। আমাদের দেশীয় কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে পোশাক খাতের গুরুত্ব অনেক। বর্তমানে রিজার্ভের একটা সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। এক বছর আগে আমাদের যে রিজার্ভ ছিল তার চেয়ে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। এ রিজার্ভকে ঠিক রাখতে হলে আমাদের রপ্তানি খাতটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদেরকে পোশাকখাতসহ অন্যান্য রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো চলে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে আমাদের কর্মসংস্থান ও আমাদের অর্থনীতিতে ডলারের যে প্রবাহ বাড়ছে সেটা থাকবে। তাই এ জায়গাগুলোতে শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে হবে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বলেন, করোনার পর গতবছর কল-কারখানা খোলার পর পণ্য আমদানি-রপ্তানি বেড়ে যায়। আর এবছর গত কয়েক মাস ধরে ডলারের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা অনেক হিসেব কষে কাঁচামাল আমদানি করছে। এছাড়া বৈশ্বিক মন্দার কারণে বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি কমিয়েছে। ফলে সম্প্রতি আমদানি-রপ্তানি দুটোই কমেছে।