লাইভ চলাকালে সাংবাদিকদের মারধর, ক্যামেরা ভাঙচুর
স্টাফ রিপোর্টার: বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) কার্যালয়ে স্যাটেলাইট চ্যানেলের লাইভ অনুষ্ঠানে দুই সাংবাদিকের ওপর হামলা ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ক্যামেরা ভাঙচুর ও বুম ভেঙে ফেলা হয়েছে। সোমবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে বিএমডিএ কার্যালয়ের সামনে বিএমডিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ হামলা চালায়।
আহত দুই সাংবাদিক হলেন বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যালেন এটিএন নিউজের রাজশাহী প্রতিনিধি বুলবুল হাবিব ও ক্যামেরাপারসন রুবেল ইসলাম। হামলায় গুরুতর আহত রুবেল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। হামলার ঘটনায় দুই কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। হামলার নির্দেশদাতা বিএমডিএ-এর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদসহ হামলাকারী অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
হামলার শিকার বুলবুল হাবিব বলেন, সরকারি নির্দেশনায় সকাল ৮টায় অফিস শুরু হবার কথা। সেই নির্দেশনা কতটুকু কার্যকর হয়েছে তা অফিস থেকে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়। সোমবার সকাল পৌনে আটটার দিকে বিএমডিএ কার্যালয়ে যাওয়া হয়। সোয়া আটটা পর্যন্ত কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া কোন কর্মকর্তা উপস্থিত হননি। সকাল ৮টা ২০ মিনিটের দিকে বিএমডিএ’র নির্বাহী পরিচালক (ইডি) আবদুর রশিদ অফিসের গাড়ি নিয়ে বিএমডিএতে আসেন। এসেই তিনি আমাদের ওপর চড়াও হন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, কার অনুমতি নিয়ে কার্যালয়ের চত্বরে প্রবেশ করেছি। বিনা অনুমতিতে কেন ভিডিও ধারণ করা হচ্ছে। এসময় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে তার দপ্তরে চলে যান।
বুলবুল হাবিব আরও বলেন, কিছুক্ষণ পরে ১৫-২০ জন লোক আমাদের ঘিরে ধরে। আমাদের ওপর এলোপাথাড়ি হামলা চালায় এবং ক্যামেরা ও বুম ভেঙে ফেলে। তাদের হামলায় আমার ক্যামেরাপারসন রুবেল গুরুতর আহত হন। রুবেলকে শক্ত কোনো কিছু দিয়ে তারা জোরে আঘাত করে। বর্তমানে তার অবস্থা গুরুতর। এমন অবস্থায় তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় একাধিক বার মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলেও বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদ ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে এর মধ্যেই সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় দুই কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। হামলার নির্দেশদাতা বিএমডিএ-এর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদসহ হামলাকারী অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিএমডিএর রাজশাহী কার্যালয়ের সচিব শরিফ আহম্মেদের স্বাক্ষরিত চিঠিতে এসব বিষয় জানানো হয়। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া দুজন হলেন, বিএমডিএ-এর রাজশাহী কার্যালয়ের ভাণ্ডাররক্ষক জীবন আহমেদ ও একই কার্যালয়ের গাড়িচালক আবদুর সবুর। এর মধ্যে জীবন আহমেদ বিএমডিএ কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক।
বিএমডিএ’র নির্বাহী পরিচালককে প্রধান আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেছেন এটিএন নিউজের রাজশাহী প্রতিনিধি বুলবুল হাবিব। সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি মামলাটি করেন। মামলায় নির্বাহী পরিচালক ছাড়াও সাতজনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরও ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলেনÑ বিএমডিএ’র ভাণ্ডার রক্ষক জীবন, নির্বাহী পরিচালকের কার্যালয়ের পিয়ন সেলিম, পিএ নুরুল ইসলাম, আনসার সদস্য এনামুল হক, দপ্তরের পিয়ন ফারুক, ও গাড়িচালক আবদুস সবুর। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, মামলাটি গ্রহণ করা হয়েছে। এবং একজন উপপরিদর্শককে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
লাইভ ফুটেজে দেখা যায়, জীবন, সবুরসহ আরও ১৫-২০ জন হামলায় অংশ নেন। সাংবাদিক বুলবুল হাবিবকে কিলঘুষি মারেন জীবন ও নির্বাহী পরিচালকের পিএ নুরুল হক ও আনসার এনামুল হক, পিয়ন ফারুক। তারা মারতে মারতে তাদেরকে কার্যালয় থেকে বের করে রাস্তায় নিয়ে যায়। সেখানে এসে রুবেলের হাতে থাকা ক্যামেরা ভাঙচুর ও বুলবুলের কাছ থেকে বুম ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙে ফেলেন। জীবন রুবেলকে হাতুড়ি দিয়ে মাথায় ও কানে আঘাত করেন। রুবেল বাম কানে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন।
এদিকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলার ঘটনায় রাজশাহীতে কর্মরত সাংবাদিকরা বিএমডিএ কার্যালয়ের সামনে হামলার প্রতিবাদ ও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। দোষী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করে সাংবাদিকেরা সেখানে বক্তব্য দেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বহিষ্কার ছাড়া তারা অবস্থান থেকে সরবেন না বলে জানান। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে বিএমডিএর চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য বেগম আখতার জাহান কার্যালয়ে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করে বিএমডিএ কার্যালয়ে গিয়ে তিনি সভায় বসেন। বেলা দেড়টার দিকে তিনি জানান, অভিযুক্ত দু জন কর্মচারিকে তারা বদলি করে দেবেন।
সাংবাদিকরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বহিষ্কারসহ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার শাস্তি দাবি অব্যাহত রাখলে আখতার জাহান আবার সভায় বসেন। এর মধ্যে কয়েকজন সাংবাদিক নেতাকেও তারা আলোচনা সভায় ডেকে নেন। পরে বেলা আড়াইটার দিকে আখতার জাহান এসে জানান, তারা অভিযুক্ত দুই জন কর্মচারীকে সাময়িক বহিষ্কারের আদেশ নিয়ে এসেছেন। এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিগগিরই তদন্ত কমিটি হবে। তিনি সরাসরি নির্বাহী পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না। এটা মন্ত্রণালয় তদন্ত প্রতিবেদন দেখে সিদ্ধান্ত নেবে।
আলোচনা সভা শেষে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা যে দাবি নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিলাম, তা বাস্তবায়ন হয়েছে। এরই মধ্যে দুই জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ হামলায় আরও যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছে। এছাড়া ঘটনায় নির্দেশদাতার বিরুদ্ধে বিএমডিএ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তদন্ত করে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের সহকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়ে বিএমডিএ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে পুরোপুরি হরণ করেছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে তারা শুধু বাধাই দেয়নি, তাদের ওপর হামলা চালিয়ে বিএমডিএ কার্যালয়ের সামনে থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করা হয়েছে। আমাদের দাবি, কৃষি মন্ত্রণালয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। আমরা সেই তদন্তের অপেক্ষায় আছি।
হামলার শিকার সাংবাদিক বুলবুল হাবিব বলেন, হামলার পরপরই তার সহকর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। এজন্য তাদের ধন্যবাদ। নির্দেশদাতা নির্বাহী পরিচালক এবং আরও অন্তত ১৫ জন হামলা চালিয়েছেন। তাদেরও শাস্তির দাবি করেছেন তিনি।
সাংবাদিকদের ওপর হামলা ‘অনাকাক্সিক্ষত’ দাবি করেন বিএমডিএ চেয়ারম্যান বেগম আখতার জাহান। তিনি বলেন, ঘটনার পর ভিডিও ফুটেজ দেখা হয়েছে। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দুইজন কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে। তদন্তে আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএমডিএ চেয়ারম্যান বলেন, আমরা নির্বাহী পরিচালকের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারি না। তদন্ত প্রতিবেদন আসার পর সে অনুযায়ী মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে। মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে।