ঢাকা | ডিসেম্বর ২৭, ২০২৫ - ৭:৪৯ পূর্বাহ্ন

ঘ্রাণ নেই খেজুর রসের, গাছিদের আক্ষেপ

  • আপডেট: Saturday, December 27, 2025 - 12:17 am

নওগাঁ প্রতিনিধি: ভোরের কুয়াশায় ভেজা ঘাসের ডগা থেকে মেঠোপথের আইল জানান দিচ্ছে শীত এসেছে। নওগাঁর গ্রামীণ জনপদে কুয়াশার চাদর মোড়ানো ভোরে গাছিদের ব্যস্ততা, কোমরে রশি আর হাতে ধারালো দা- সবমিলিয়ে এ যেন এক চিরায়ত বাংলার রূপছবি। অবহেলিত খেজুর গাছগুলো এখন হয়ে উঠেছে রুপালি রসের উৎস আর গাছিদের সোনালি স্বপ্নের সারথি। নওগাঁর আত্রাই, মান্দা, পত্নীতলা, সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় এখন খেজুর গাছ ‘তোলার’ ধুম লেগেছে। বছরজুড়ে অযত্নে পড়ে থাকা গাছগুলো এখন গাছিদের পরম বন্ধু। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাস থেকেই শুরু হয় গাছ পরিষ্কারের কাজ। গাছের ডাল কেটে মাথা চেঁছে কয়েক দিন শুকানো হয়।

গাছের ওপরের দিকে বিশেষ কায়দায় ‘চোখ’ কেটে বাঁশের নলি বসানো হয়। সেখান থেকেই টুপটুপ শব্দে ঝরে পড়ে কাঙ্ক্ষিত রস, যা ভোরের শিশিরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জমা হয় মাটির হাঁড়িতে। এই মৌসুমটি স্থানীয় গাছিদের জন্য আয়ের প্রধান উৎস। আত্রাইয়ের সাহাগোলা এলাকায় নাটোর থেকে আসা অভিজ্ঞ গাছি আব্দুল আজিজ জানান, ২৫ বছর ধরে তিনি এই কাজ করছেন। শতাধিক গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করেন। অন্য এক গাছি আব্দুল খালেক জানান, তিনি এবার ৪০টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করবেন। একটি গাছ থেকে দৈনিক প্রায় ৪ কেজি রস পাওয়া যায়। ৬ কেজি রস জাল দিয়ে তৈরি হয় ১ কেজি খাঁটি গুড়। মৌসুমে গুড় বিক্রি করে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। মিষ্টি রসের সুবাস থাকলেও এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। নতুন প্রজন্মের তরুণরা এই পরিশ্রমী পেশায় আসতে আগ্রহী নয়। অভিজ্ঞ গাছিদের বয়স হয়েছে। সংগত কারণেই কমছে গাছির সংখ্যা।

এ ছাড়া ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছ কাটা এবং নতুন গাছ না লাগানোর ফলে গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। মান্দার গণেশপুর গ্রামের গাছি আক্কাস আলী জানান, আগে ১০০ গাছ কাটতেন, এখন ৫০-৬০টিতে নেমে এসেছে। গাছ কমছে, গাছিও হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ আর এই পেশায় আসে না। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, খেজুরের গুড় শুধু খাবারের অনুষঙ্গ নয়, এটি গ্রামীণ অর্থনীতির একটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি। এক সময় জেলায় ৫০ হেক্টর জুড়ে ছিল খেজুর বাগান। বর্তমানে আনুমানিক ৪৫ হেক্টরে এ গাছ রয়েছে। অতিরিক্ত উপপরিচালক খলিলুর রহমান বলেন, এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে পরিকল্পিতভাবে রাস্তার ধারে ও বাড়ির পাশে নতুন খেজুর চারা রোপণ করা জরুরি।

খেজুর রসে প্রাণঘাতী ঝুঁকি: শীত এলেই দেশে নিপাহ ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ বাড়ে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ভাইরাসের সঙ্গে কাঁচা খেজুরের রসের সম্পর্ক বহু বছর ধরেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। বাদুড় এই ভাইরাসের প্রাকৃতিক বাহক। রস ভোরে সংগ্রহ করে কাঁচা অবস্থায় পান করলেই মানুষের শরীরে ভাইরাস প্রবেশের ঝুঁকি তৈরি হয়। এখান থেকেই শুরু হয় মারাত্মক অসুস্থতা, যার পরিণতি অনেক সময় মৃত্যু। প্রতি বছর শীত মৌসুমে গাছিরা খেজুর গাছে মাটির হাঁড়ি বা কলস পেতে রস সংগ্রহ করেন। তবে এসব হাঁড়ির খোলা মুখে শুধু খেজুর রসই জমা হয় না, রাতের আঁধারে খাদ্যের সন্ধানে আসা বাদুড় ও বিভিন্ন পাখিরও অবাধ বিচরণ ঘটে সেখানে। ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতে নিশাচর বাদুড় খেজুর গাছের হাঁড়িতে বসে রস পান করে। এ সময় তারা হাঁড়ির কিনারে ঝুলে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে রসের ভেতরেই মল-মূত্র ত্যাগ করে। ফলে রস দূষিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), মেডিকেলের চিফ ডা. মো. মকসেদ আলীর মতে, বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়ানো ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে তা মারাত্মক রোগের কারণ হতে পারে, অনেক সময় প্রাণঘাতীও হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কাঁচা বা অপরিশোধিত খেজুর রস সরাসরি পান করলে ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। খেজুর রস বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এর নিরাপদ সংগ্রহ ও ভোগ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। খেজুর রস সংগ্রহের সময় হাঁড়ির মুখ ঢেকে রাখা, কাঁচা রস না খাওয়া এবং রস ভালোভাবে ফুটিয়ে নেয়ার পর ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, সামান্য সচেতনতা ও সতর্কতাই পারে এই নীরব কিন্তু ভয়ংকর ঝুঁকি থেকে মানুষকে রক্ষা করতে।