ঢাকা | ডিসেম্বর ২৬, ২০২৫ - ৬:১৬ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম

শীতে কাঁপছে উত্তরাঞ্চলের ছয় জেলা, কষ্টে মানুষ

  • আপডেট: Friday, December 26, 2025 - 12:00 am

স্টাফ রিপোর্টার: উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলা নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাটে শীতের তীব্রতা বাড়ছে। বিশেষ করে কয়েক দিন ধরে হিমেল হাওয়া ও উচ্চ আর্দ্রতার কারণে শীতের উপস্থিতি এসব জেলায় স্পষ্টভাবে অনুভূত হচ্ছে।

ফলে দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক, রিকশাচালকসহ নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ কাজে যেতে পারছেন না। শীতের তীব্রতা ছাপিয়ে কাজের তাগিদে বের হলেও তাদের কষ্ট যেন এখন সীমাহীন পর্যায়ে। এছাড়াও শীতজনিত ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে শিশু এবং বৃদ্ধরা আক্রান্ত হচ্ছেন।

নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁয় বেড়েছে শীতের তীব্রতা। দিন যতই যাচ্ছে ততই বাড়ছে শীত। সন্ধ্যার পর হিমেল বাতাস শীতকে বাড়িয়ে তুলছে কয়েকগুণ। দিনে ঠিকমতো দেখা মিলছে না সূর্যের। নওগাঁর বদলগাছী কৃষি ও আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের তথ্য মতে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বুধবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বুধবার দুপুর ১টার পর সূর্যের দেখা মিললেও গতকাল এখন পর্যন্ত দেখা মিলেনি সূর্যের। ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারপাশ। ছোট থেকে মাঝারি যানবহনগুলো চলাচল করছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। হঠাৎ করে শীত বেড়ে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে শ্রমজীবী এবং নিম্ন মধ্যম আয়ের মানুষদের। নওগাঁর বর্ষাইল এলাকার সবজি বিক্রেতা আনিসুর রহমান বলেন, এক সপ্তাহ থেকে শীত অনেক বেশি। ভোরে সবজি ধুয়ে এরপর টুকরিতে সাজানো লাগে। শীতে এসব ধোঁয়ার কাজ করতে অনেক কষ্ট হয়। সকাল থেকে সাইকেলে করে এসব সবজি শহরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বিক্রি করি। শীত বেশি হওয়ায় সকালে মানুষজন বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। যার জন্য বেচা বিক্রিও তেমন নেই। পেটের দায়ে ঠান্ডা লাগলেও বাইরে আসতে হচ্ছে। বদলগাছী আবহাওয়া ও কৃষি পর্যবেক্ষণাগারের উচ্চ পর্যবেক্ষক মাহবুব আলম বলেন, জেলায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। দিনে সূর্য ঠিকমতো উদিত না হওয়ায় শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। সামনে তাপমাত্রা আরও কমতে পারে।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৯ শতাংশ। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার নলিছাপাড়া গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন (৭৩)। প্রতিদিন সকাল ও বিকালে শহরের বিভিন্ন স্থানে লাউ শাক বিক্রি করেন। এ থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে চলে তার সংসার। বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টার দিকেও কনকনে ঠান্ডা থাকায় শহরের বাহিরগোলা বাজারে শাক বিক্রি শেষ না করে বাড়ি ফিরে যান তিনি। রিকশাচালক মঞ্জিল সেখ বলেন, জ্বরের জন্যে ঠিকভাবে রিকশা চালাতে পারছি না। কিস্তি ট্যাহায় রিকশা কিনছি, ঘরে থাকলে কিস্তি দিমু ক্যামনে। এজন্য বের হয়েছি। শহরের আরেক রিকশাচালক জুলহাস বলেন, একদিন কাম না করলে ঘরে চাল ডাল থাকে না। এদিকে ঠান্ডায় শরীর কাঁপে। কনকনে জার আর কুয়াশার জইন্যে যাত্রীও বাইর হয় কম। সদর উপজেলার শ্যামপুর গ্রামের শাহ আলম বলেন, মাঠে কাজ থাকলেও ঠান্ডার কারণে কাজে যাচ্ছি না। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে পরিবারের সবাই মিলে খড়কুটোর আগুন জ্বালিয়ে দিন কাটাচ্ছি। তাড়াশ আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, কনকনে ঠান্ডার সঙ্গে হিমেল বাতাস থাকায় শীতের প্রকোপ বেড়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ অবস্থা আরও কয়েকদিন থাকতে পারে।

বগুড়া প্রতিনিধি জানান, বগুড়ায় জেঁকে বসেছে হাড়কাঁপানো শীত। এই জেলায় চলতি মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তরের হিমেল বাতাস আর ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে পুরো জনপদ। দিনভর সূর্যের দেখা না মেলায় কনকনে ঠান্ডায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। বগুড়া আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, সকাল ৯টায় জেলায় এ মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এর আগে গত মঙ্গলবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক শাহিদুজ্জামান সরকার বলেন, সকাল থেকে জেলাজুড়ে ঘন কুয়াশা রয়েছে। বাতাসের আর্দ্রতার কারণে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ছে। সামনের দিনগুলোতে তাপমাত্রা আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে। শীতের তীব্রতায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া ও নিম্ন আয়ের মানুষ। গতকাল সকাল থেকে কুয়াশার কারণে সড়ক-মহাসড়কে দৃষ্টিসীমা কমে আসায় যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে।

জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, টানা এক সপ্তাহ ধরে পশ্চিমা বাতাশে স্থবির হয়ে পড়েছে জয়পুরহাটের জনজীবন। ঘন কুয়াশার সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে শীতের প্রকোপ, বৃষ্টির পানির মতো ঝরছে কুয়াশা। পাকা সড়ক ভিজে গেছে। মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহন হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরগতিতে চলাচল করছে। তবুও জীবিকার প্রয়োজনে বের হচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ। ফলে শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগ। হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্থানীয়রা জানান, গত বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত দেখা মেলেনি সূর্যের। এতে বস্তিবাসী ও ছিন্নমূল মানুষরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। বিশেষ করে কৃষকরা আলুর খেত ও আগাম ইরি-বোরো রোপণের কাজ করতে গিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। জয়পুরহাট-বগুড়া মহাসড়কে বিআরটিসির বাসচালক মুহিবুল বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে একই অবস্থা। কুয়াশা কমে না। দিনের বেলায় হেডলাইট জ্বালিয়ে বাস চালাতে হচ্ছে। পাবনা থেকে বাসটি মাত্র কয়েকজন যাত্রী নিয়ে জয়পুরহাট পর্যন্ত এসেছি। ঠান্ডার কারণে যাত্রী নেই বললেই চলে। এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়তো বাস চলাচল বন্ধ রাখতে হবে। এদিকে শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগ। জয়পুরহাট ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত কয়েকদিনে তুলনায় গত মঙ্গলবার বিকাল থেকে হাসপাতালের শিশু ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বেড়েছে। নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আবার অনেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি গেছে। জয়পুরহাট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রাশেদ মোবারক জুয়েল বলেন, কয়েকদিনের প্রচণ্ড ঠান্ডার কারনে শিশু ও বৃদ্ধরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। শীত বাড়ায় শিশু ও বয়স্কদের ঘরের বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

পাবনা প্রতিনিধি জানান, পদ্মা-যমুনা নদীবেষ্টিত পাবনায় শীত জেঁকে বসেছে। ঘন কুয়াশা এবং হাড় কাঁপানো শীতে জনজীবন কাহিল হয়ে পড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টা ধরে সূর্যের দেখা নেই। দুপুর পর্যন্ত প্রকৃতি ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকছে। এদিকে তাপমাত্রার পারদ ক্রমশ নিচে নামছে। গত বুধবার পাবনায় তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ১১ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়। ঈশ্বরদী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের আবহাওয়া পর্যবেক্ষক নাজমুল হোসেন জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ১২ ডিগ্রিতে ওঠা-নামা করছিল। বুধবার তাপমাত্রার পারদ সর্বনিম্ন ১১ ডিগ্রিতে নেমে আসে। হাড়কাঁপানো শীতে পদ্মা-যমুনা নদীর চরাঞ্চলের ২ লক্ষাধিক মানুষসহ অন্তত ৫ লক্ষাধিক মানুষ কষ্ট পাচ্ছেন। দিনমজুর ও নিম্নআয়ের মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। শীতে কাজ করতে না পারায় মানবেতর দিন যাপন করছেন তারা। শীতজনিত ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে শিশু এবং বৃদ্ধরা আক্রান্ত হচ্ছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় পাবনা জেনারেল হাসপাতালসহ জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ২ শতাধিক শিশু ও বয়স্ক মানুষ ভর্তি হয়। পাবনা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. জাহিদুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ১১৫ জন শীতজনিত রোগী ভর্তি হয়েছে।