সার সঙ্কট, বিপাকে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার আলুচাষি
জগদীশ রবিদাস: চলতি মৌসুমে রাজশাহী তথা উত্তরাঞ্চলে রবিশস্য, বিশেষ করে আলু ও পেঁয়াজ চাষিরা তীব্র সার সঙ্কটে পড়েছেন। বেশি বিপাকে পড়েছেন এই অঞ্চলের আলু চাষিরা। গত বছর আলু চাষ করে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছিলেন রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলার আলুচাষিরা।
সেই লোকসান পুষিয়ে নিতে চলতি মৌসুমেও আলু লাগানোর কথা ছিল তাদের। তবে বিপত্তি বেধেছে রাসায়নিক সার নিয়ে। কৃষকরা জানিয়েছেন, স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ডিলার পয়েন্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও চাহিদা মোতাবেক সার পাওয়া যাচ্ছে না।
ফলে ব্যাহত হচ্ছে রোপণ কার্যক্রম। শুধু রাজশাহীর আলু চাষিরাই নন, তাদের মতো উত্তরাঞ্চলের প্রায় ১৬ জেলার হাজার-হাজার কৃষক আলু চাষের মৌসুমের শুরুতেই সার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
চাষিরা অভিযোগ করছেন, অনৈতিক মুনাফালোভী ডিলাররা অত্যন্ত গোপনে সরকারিভাবে বরাদ্দ সার কালোবাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে সরকার অনুমোদিত ডিলার পয়েন্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও প্রয়োজনীয় সার মিলছে না। আবার কোথাও সার মিললেও কৃষকের জমির তুলনায় যে সার প্রয়োজন, সেই পরিমাণ দেয়া হচ্ছে না। যা চলতি রবিসশ্যের মৌসুমে আলু ও শীতকালীন সবজি চাষের জন্য একেবারেই অপ্রতুল।
রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলার চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা দেখা গেছে, সারের এমন সঙ্কটের কারণে অধিকাংশ চাষি বাধ্য হয়ে চাহিদার চেয়ে কম সার দিয়েই আলু রোপণ করছেন। ফলে এই মৌসুমে আলুর ফলন নিয়ে শঙ্কা কাটছে না। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আলু চাষের শুরুতেই সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ না হলে গাছের প্রাথমিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, যার প্রভাব পড়ে পুরো মৌসুমের ফলনে।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার চাষি মিজানুর রহমান বলেন, যতটা সার দেয়ার কথা, তার চেয়ে কম দিয়েই বীজ লাগাতে হয়েছে। এতে ফলন কম হবে এটা নিশ্চিত। সুইট নামে আরেক কৃষক জানান, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী রাঁতের আধারে অনুমোদিত দোকান ও গুদামে না রেখে বাড়ি ও গোপন স্থানে সার মজুত করছেন। পাশাপাশি মাছচাষিরা পুকুরে ইউরিয়া ব্যবহার করায় কৃষি খাতে সারের সঙ্কট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
কিছুদিন আগে রাজশাহীর বাগমারায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার বাড়ি থেকে ৪৪৪ বস্তা অবৈধভাবে মজুত করা সার জব্দ করা হয়। পরে সেগুলো সরকারি দামে কৃষকদের মধ্যে বিক্রি করা হয়।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাবিনা বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, সারের তেমন কোনো সঙ্কট নেই। অনেক কৃষক প্রয়োজনের তিন থেকে চার গুণ বেশি সার ব্যবহার করছেন। যেখানে জমিতে ৩০-৩৫ কেজি সার ব্যবহার করা দরকার, সেখানে অনেকে ১০০ কেজি পর্যন্ত প্রয়োগ করছেন। ডিএপি সারে ফসফেট উপাদান থাকায় অনেক ক্ষেত্রে আলাদা করে টিএসপি ব্যবহারের প্রয়োজন নেই।
তবু কৃষকরা ডিএপি ও এমওপি একসঙ্গে ব্যবহার করছেন। কৃষকদের সচেতন করতে মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী ও লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে জানিয়ে সাবিনা বেগম আরও বলেন, কিছু এলাকায় টিএসপি ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে, যা আইনবিরোধী। কৃষকদের অবশ্যই ক্যাশ মেমো নিতে হবে। এতে অতিরিক্ত দাম নেয়া ঠেকানো যাবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে মোট আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ টন। এর মধ্যে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগেই উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৮৭ লাখ টন। চলতি মৌসুমে এই দুই বিভাগে ৩ লাখ ৪৩ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৮৪ লাখ টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
কৃষকদের হিসাবে, প্রতি বিঘা জমিতে আলু চাষের শুরুতেই প্রয়োজন প্রায় ২ বস্তা (১০০ কেজি) এমওপি, ১ বস্তা (৫০ কেজি) ডিএপি এবং ১ বস্তা টিএসপি। তবে এর বিপরীতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরাদ্দ দিচ্ছে বিঘা প্রতি মাত্র ২৩ দশমিক ১৫ কেজি এমওপি, ৩৬ কেজি ডিএপি ও ১ দশমিক ৩ কেজি টিএসপি, যা কৃষকদের মতে বাস্তব চাহিদার তুলনায় অনেক কম।
রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে রাজশাহী কৃষি অঞ্চলের চার জেলায়- রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এমওপি সার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৫৫১ টন, ডিএপি ২৫ হাজার ২৮১ টন এবং টিএসপি ৯ হাজার ৫৭০ টন।
আর চলতি ডিসেম্বর চার জেলায় ১৫ হাজার ৩৮০ টন এমওপি, ২৯ হাজার ৪৫০ টন ডিএপি এবং ৯ হাজার ৪৬৬ টন টিএসপি সার বরাদ্দ দেয়া হবে। রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) অনুমোদিত ডিলার পয়েন্টগুলোর সামনে সকাল থেকেই কৃষকদের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে।
এদিকে, সঙ্কটের কারণে বিকল্প উৎস থেকে অতিরিক্ত দামে কৃষকরা সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানা গেছে। রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষক লুৎফর রহমান অভিযোগ করে বলেন, সরকারি দামে সার না পেয়ে তিনি বাইরে থেকে প্রতি বস্তা টিএসপি ও ডিএপি সার ১ হাজার ৭০০ টাকায় এবং এমওপি সার ১ হাজার ৩৫০ টাকায় কিনে জমিতে আলু লাগিয়েছেন।
অথচ সরকার নির্ধারিত এমওপি সারের মূল্য ১ হাজার, ডিএপি ১ হাজার ৫০ এবং টিএসপি ১ হাজার ৩৫০ টাকা। পবার দামকুড়া বাজারের সার ডিলার নজরুল ইসলাম জানান, সঙ্কটের কারণে কৃষকদের চাহিদা মতো সার দিতে পারছেন না তিনি। ডিসেম্বর মাসের নতুন বরাদ্দ পেলে আবার টিএসপি ও ডিএপি সার দিতে পারবেন। একই অবস্থা তৈরি হয়েছে জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই।
পুঠিয়া, দুর্গাপুর, বাগমারা, চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় ডিএপি সার পাওয়া গেলেও মিলছে না টিএসপি সার। ফলে এসব উপজেলায়ও আলুচাষিরা এখন বেকায়দায় পড়েছেন। টিএসপি ও এমওপি সার সঙ্কটের কারণে আলুচাষ শুরু করতে পারছেন না অনেক কৃষক।
তানোর উপজেলার সার ডিলার মাইনুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, কৃষকদের চাহিদা মোতাবেক সার দিতে পারছি না। যে বরাদ্দ দেয়, তা দিয়ে কৃষকদের মন রক্ষা করা যাচ্ছে না। আমরা কী করব! সরকার যেভাবে দেয়, আমরা সে মোতাবেক সবার মাঝে বিতরণ করি। বেশি দামে সার বিক্রি করার প্রশ্নই আসে না। খুচরা সার বিক্রেতা শাহ আলম দাবি করেন, আমরা তুলনামূলক সার পাচ্ছি না। পেলেও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। যার কারণে বেশি দামে সার বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের কাছে।
সার সঙ্কটের বিষয়ে দুর্গাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহানা পারভিন লাবনী গণমাধ্যমকে বলেন, বেশি দামে সার কেনার বিষয়টি আমার জানা নেই। সার সঙ্কট না হওয়ারই কথা। যেহেতু আলু চাষ পুরোদমে শুরু হয়নি। তবে কৃষিজমি বাদে পুকুরে সার প্রয়োগ করায় এ সঙ্কট দেখা দিতে পারে।
এদিকে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নভেম্বর মাসে জেলায় ২২০ জন ডিলারের মাঝে সাত হাজার ৩০৭ টন ইউরিয়া, তিন হাজার ১৮৬ টন টিএসপি, সাত হাজার ৮৩৯ টন ডিএপি ও পাঁচ হাজার ৬৩৭ টন এমওপি সার বরাদ্দ দেয়া হয়। আনুমানিক ১৬ হাজার কৃষকের জন্য বরাদ্দ অনুযায়ী প্রায় সব ডিলারই অধিকাংশ সার উত্তোলন করেছেন।










