গর্তে পড়া সাজিদের ‘মা, মা’ ডাক ভুলতে পারছেন না মা
স্টাফ রিপোর্টার: তিন-চার কাঠা জমির এক পাশে ছোট্ট বাড়িটি ঘিরে এখন শুধুই হাহাকার। বাড়ির চারপাশে কৃষিজমি। বাড়ি লাগোয়া দুটি পুকুরও আছে। গত দুই দিনে সেই জমিতে হাজারো মানুষের পায়ের ছাপে তৈরি হয়েছে ধুলার আস্তরণ।
মাটির এই নীরব জবাব যেন সাক্ষী দিচ্ছে মর্মান্তিক এক ঘটনার। রাজশাহীর তানোরের নিভৃত গ্রামে অবহেলায় প্রাণ গেল দুই বছরের শিশু সাজিদের।
গতকাল শুক্রবার বাড়ির আঙিনায় খাটিয়ায় শুইয়ে রাখা ছিল সাজিদের নিথর দেহ। ছোট্ট শিশুটিকে শেষবার দেখতে ভিড় করেন হাজারো মানুষ। ভিড়ের মধ্যে আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল সাজিদের মা রুনা খাতুনকে।
সন্তানের শোকে পাথর হয়ে যাওয়া এই মা বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘গর্তে পড়ে ছেলেটা মা, মা বলে ডাকছিল। তখন হাউসের (গর্ত) কাছেই ছিল। আমার বাচ্চাটাকে জীবিত দিতে পারেনি, মৃত দিছে। মৃত মানুষকে কোনো মানুষ ফেরাতে পারে না। যদি অন্যায় হয়ে থাকে, বিচার করবেন। আমি মানুষ হয়ে মানুষের বিচার চাইব কীভাবে?’ শিশু সাজিদ তানোরের কোয়েলহাট গ্রামের রাকিবুল ইসলামের ছেলে।
ঘটনার সূত্রপাত গত বুধবার দুপুরে। মায়ের সঙ্গেই বাড়ির পাশে গিয়েছিল সাজিদ। হঠাৎ করেই মায়ের চোখের আড়াল হয়ে যায়। এরপরই ভেসে আসে, ‘মা, মা’ চিৎকার। মা রুনা খাতুন বুঝতে পারেন, তাঁর কলিজার টুকরা তলিয়ে গেছে গভীর গর্তে।
খবর পেয়ে ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, প্রশাসন ও সেনাবাহিনী। শুরু হয় শ্বাসরুদ্ধকর উদ্ধার অভিযান। এলাকাবাসী ও প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় টানা ৩২ ঘণ্টা চলে এ যুদ্ধ। সাজিদ কী বেঁচে আছে আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলছিল পুরো দেশ। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার রাতে সাজিদকে যখন তুলে আনা হলো, তখন সে আর নেই। চিকিৎসকেরা জানালেন, আগেই মৃত্যু হয়েছে তার।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় বাড়ির পাশের যে জমিতে সাজিদের জানাজা হয়, সেখানে সাধারণত গ্রাম্য ঘোড়দৌড় হয়। গ্রামের বাসিন্দা মজিবুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এখানে ঘোড়দৌড়েও এত মানুষ হয় না, যত মানুষ ছোট্ট সাজিদের জানাজায় হয়েছে।’ জানাজা শেষে খাটিয়া যখন কবরস্থানের দিকে নেওয়া হচ্ছিল, তখন তৈরি হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। কবরে নামানোর সময় এক মাওলানা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, ‘ছোট মানুষ, আস্তে মাটি দেন। অল্প করে দেন।’ এই মৃত্যকে অবহেলাজনিত ‘হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ওই এলাকায় গভীর নলকূপ বসানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবু পানির আশায় এক ব্যক্তি গর্ত খুঁড়েছিলেন। পানি না পাওয়ায় মুখটি আলগা মাটি দিয়ে দায়সারাভাবে ভরাট করা হয়, যা বর্ষায় ধসে গিয়ে মরণফাঁদে পরিণত হয়েছিল। সন্তানহারা বাবা রাকিবুল ইসলাম এখন বাক্রুদ্ধ। শুধু বললেন, ‘অন্যের অবহেলার জন্য আমার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। আমি প্রশাসনের কাছে এর বিচার চাই।’
গ্রামবাসীও এই অবহেলার বিচার চান। গ্রামের বাসিন্দা মো. রাশেদ বলেন, ‘গ্রামের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এখন ১০০-১৫০ ফুট নিচেও পানি নেই। একটি নলকূপ বসাতে হলে কয়েক জায়গায় বরিং করতে হয়। গ্রামের এগুলো সাধারণ বিষয়। কিন্তু এগুলো বন্ধ করে দেওয়া দরকার ছিল। আমিও এই অবহেলার বিচার চাই।’
দুপুর গড়াতেই সাজিদদের বাড়িটি ফাঁকা হয়ে গেল। সাজিদের বাবা বাড়ির পাশে ছেলের দাফন শেষে সেই গর্তের সামনে গেলেন। বললেন, ‘আমার ওই বাড়িভিটেটাই শুধু। আর তিন রতন ছিল। এক রতন কেড়ে নিল এই গর্ত।’ বললেন, একটু পর ছেলের কবরের কাছে যাবেন। ছোট্ট সাজিদের নতুন কবরের মাটি এখনো ভিজে আর বাতাসে ভাসছে সাজিদের মায়ের সেই হাহাকার, ‘ছেলেটা মা, মা বলে ডাকছিল…।’









