রাজশাহী নগরীতে ‘কৌশলে’ চলছে পুকুর ভরাট
স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহী নগরীতে নিষেধাজ্ঞা, পরিবেশ আইন ও প্রশাসনিক নির্দেশনা উপেক্ষা করে কৌশলে পুকুর ভরাট করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধুমাত্র পুকুর ভরাটই নয়, সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে ভিন্ন নামে বাহারি স্থাপনা।
নগরীর বিভিন্ন স্থানে এমন চিত্র দেখা গেলেও সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে লিচুবাগান এলাকার (ঘোষপাড়া সংলগ্ন) বিশালাকৃতির পুকুরটি।
রোববার সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, কয়েক বছর আগেও প্রায় বছরজুড়েই পানিতে ভরপুর থাকতো পুকুরটি। কিন্তু সম্প্রতি ক্রমেই কমে আসছে প্রায় ৬৪ কাঠা বিশিষ্ট পুকুরটির জলাধার।
চারদিকে পাড় বাঁধা থাকলেও কমে আসছে পুকুরের আকারও। পুকুরের পশ্চিম পাশে ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে খাবার হোটেল, তার পাশেই পাইলিং করা হচ্ছে বহুতল ভবনের, আর পূর্ব পাশে ভরাট করে গড়ে উঠেছে ফাস্ট ফুডের রেস্টুরেন্ট। অথচ পুকুরের উত্তর পূর্ব কর্ণারে ঝুঁলছে প্রশাসনের দেয়া নিষেধাজ্ঞার বোর্ড।
স্থানীয়রা বলছেন, পুকুরটিতে অনেক আগে থেকেই সারা বছর পানি ভরপুর থাকে। মাছ চাষের পাশাপাশি আশপাশের মানুষ বিভিন্নভাবেই ব্যবহার করে পুকুরের পানি। তবে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের আমল থেকেই কিছু দখলবাজদের নজর ছিল পুকুরটির ওপর। এই এলাকায় নতুন অনেক বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে, সে কারণে এই জায়গাতেও কিছু অসাধু ডেভেলপারের নজর পড়েছে। পুকুরের মালিকানায় যারা আছেন ধীরে ধীরে পশ্চিম, পূর্ব ও বিভিন্ন অংশে মাটি-বর্জ্য ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। পুকুরের পশ্চিম পাশে ইতিমধ্যে খাবার হোটেল চালু করা হয়েছে।
এর পাশেই নতুন ভবন নির্মাণের করে পাইলিং করা হচ্ছে। অপরদিকে পূর্ব অংশে ভরাট করে মুখরোচক খাবারের রেস্টুরেন্ট করা হয়েছে। চারপাশে ভরাটের চাপে পুকুরের মাঝ অংশটুকু এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে। যেভাবে লুকোচুরি করে বুদ্ধি খাটিয়ে ভরাট করা হচ্ছে তাতে করে মনে হয় কয়েক বছরেই এটা ভরাট হওয়ার শঙ্কা।
স্থানীয় এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুকুরটা আমাদের এলাকার বড় একটি জলাধার ছিল। কয়েক বছর আগেও এখানে মাছ ধরা হতো, গরু-মহিষকে গা ধোয়ানো হতো, বর্ষায় পানি উপচে উঠত। এখন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা ঝুলিয়েও যেভাবে দিনে-দুপুরে ভরাট চলছে, তা দেখে আমরা হতভম্ব। আমরা বহুবার অভিযোগ করেছি, কিন্তু কেউ এসে থামায়নি। এভাবে চলতে থাকলে এলাকার মানুষ ভবিষ্যতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় পড়বে এর দায় কে নেবে?
তবে পুকুর মালিকদের দাবি, অবৈধভাবে পার্শ্ববর্তী ভবনের সুয়ারেজ লাইনের পানি প্রতিনিয়ত পুকুরে ফেলা হচ্ছে। পাশাপাশি প্লাস্টিকসহ ক্ষতিকর অনেক বর্জ্য সরাসরি পানিতে ফেলা হচ্ছে। এতে পুকুরে ছাড়া মাছ হুমকির মুখে পড়েছে। দ্রুত সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনাও করেন তারা।
পুকুরের অংশীদার বনি বলেন, যেখানে ভরাট করা হয়েছে সেটুকু ভিটা। এর যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। এসিল্যান্ড অফিস থেকে যেটুকু পারমিশন করে দিয়েছে সেটুকু ভিটা, এর বাহিরে আমরা যেতে পারবো না। পুকুরের সীমানার বাহিরে কোনো ভরাট নাই, যদি যেয়েও থাকে সেটা ভুলত্রুটি হয়ে থাকতে পারে।
পুকুরের মাছচাষি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, পুকুরটি লিজ নিয়ে সব মিলিয়ে প্রায় চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা ইনভেস্ট করা আছে। সেক্ষেত্রে এই যে পাশের বিল্ডিংগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন বর্জ্য ড্রেনেজ লাইন দিয়ে পুকুরে ফেলছে। এতে আমার মাছ প্রায় প্রতিনিয়ত ভেসে উঠছে। আমি অলরেডি আলফাজ চাচাকে (পুকুর মালিক) বিষয়টা জানিয়েছি। যিনি পুকুরের মালিক উনাকে জানিয়েছি। এ ঘটনায় আমি নিজে থানায় জিডি করেছি।
ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ (ইয়্যাস) এর সভাপতি শামীউল আলীম শাওন বলেন, বেআইনিভাবে রাজশাহী জুড়ে জলাধার ভরাট করে বড় বড় ভবন নির্মাণসহ নানা ধরনের কাজ করা হচ্ছে। পুকুর সংরক্ষণের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এমনকি ঘোষপাড়ার জোড়াপুকুর ইতিমধ্যে প্রশাসন পুনরুদ্ধার করতে পুন:খননও করেছে। সেই পুকুর আবারো দখল হচ্ছে বিষয়টি দুঃখজনক। আমরা চাই অবিলম্বে সেই পুকুরসহ জেলা প্রশাসন কর্তৃক তালিকাকৃত ৯৫২টি পুকুর উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পুনরুদ্ধার করা হোক। একই সাথে এই পুকুর দখল ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জাতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, রাজশাহীতে পুকুর ভরাট এখন প্রকাশ্য পরিবেশ অপরাধে পরিণত হয়েছে। লিচুবাগান এলাকার পুকুরটি ভরাট করে হোটেল-বহুতল ভবন তোলা শুধু বেআইনি নয়, এটি নগরবাসীর জীবনের প্রতি সরাসরি হুমকি। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার সাইনবোর্ড ঝুলছে, কিন্তু তার নিচেই দিনের আলোয় চলছে ভরাট।
এদিকে রাজশাহীতে আর কোনো পুকুর ভরাট হতে দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন নবনিযুক্ত বিভাগীয় কমিশনার ড. আ.ন.ম বজলুর রশীদ। তিনি বলেন, একসময় রাজশাহী ছিল পুকুরের শহর, কিন্তু বর্তমানে অনেক পুকুর দখল ও ভরাট হয়ে গেছে। আমরা ইতিমধ্যে এসব বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। একটি ভরাট পুকুর পুনঃখননের কাজও শুরু করা হয়েছে। আমাদের পরিষ্কার সিদ্ধান্ত, রাজশাহীতে আর কোনো পুকুর ভরাট করা যাবে না। যেগুলো ইতিমধ্যেই ভরাট হয়ে গেছে, নির্বাচনের পর সেগুলো নিয়েও আমরা বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করবো।
সোনালী/জগদীশ রবিদাস










