ঢাকা | নভেম্বর ২৭, ২০২৫ - ১১:৩৮ অপরাহ্ন

উত্তরাঞ্চলে সারের ‘কৃত্রিম’ সঙ্কট, বিপাকে কৃষক

  • আপডেট: Thursday, November 27, 2025 - 9:00 pm

লাইনে দাঁড়িয়েও মিলছে না সার:

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের উত্তরের পাঁচ জেলা রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারীতে নন-ইউরিয়া সারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অতিরিক্ত টাকা দিয়েও সার পাচ্ছেন না কৃষকরা। এ সঙ্কটকে কৃত্রিম বলে দাবি করেছে কৃষি বিভাগ।

রাজশাহী জেলাতেও রয়েছে সারের সঙ্কট। বিশেষ করে ইউরিয়া, ডিএপি ও পটাশ সারের অভাব রয়েছে, যা কৃষকদের আলু ও আমন চাষে ভোগান্তির কারণ হচ্ছে।

কৃষকদের অভিযোগ, ডিলাররা কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি করছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছে তারা।

এদিকে, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি-র মতো নন-ইউরিয়া সারের তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়ায় আবাদ নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় অঞ্চলগুলোর চাষিরা। ডিলারদের কাছে সার না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন পাঁচ জেলার লাখো কৃষক। সময়মতো জমিতে সার দিতে না পারায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

তবে কৃষি বিভাগের ভাষ্য, কোনো জেলাতেই সারের ঘাটতি নেই। বিএডিসি গুদামে পর্যাপ্ত সার মজুদ থাকলেও কিছু অসাধু ডিলার বেশি মুনাফার লোভে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বাজারে দাম বাড়াচ্ছেন। এ সময় জমিতে আলু ও ভুট্টা রোপণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কৃষকরা। কিন্তু সার না পাওয়ায় জমি প্রস্তুতের কাজ আটকে আছে।

লালমনিরহাটের কর্ণপুর গ্রামের কৃষক আবদার হোসেন বলেন, ডিলারদের কাছে সারের জন্য গেলে তারা বলেন সার শেষ। কিন্তু সেই সারই খুচরা দোকানে পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে আমাদের প্রতি কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা বেশি দাম দিতে হচ্ছে। একই অভিযোগ করেন পাটগ্রাম উপজেলার বাউড়া এলাকার কৃষক আবু তালেব। তিনি বলেন, নন-ইউরিয়া সার ছাড়া জমি প্রস্তুত করা যাচ্ছে না। এখন সারের সবচেয়ে বেশি দরকার। নভেম্বরে সারের চাহিদা আরও বাড়বে। সময়মতো সার না পেলে আমাদের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। রংপুরের গঙ্গাচড়ার কৃষক সুজন মিয়া বলেন, অতিরিক্ত টাকা দিয়েও সার পাচ্ছি না, চরে কিভাবে ভুট্টা আবাদ করব তা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছি।

বিএডিসি লালমনিরহাট গুদামের সহকারী পরিচালক একরামুল হক জানান, জেলায় ১৪৪ জন ডিলারের মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত দরে সার বিক্রি হয়। সরকার ডিলারদের কাছে প্রতি কেজি টিএসপি ২৫ টাকা, ডিএপি ১৯ টাকা ও এমওপি ১৮ টাকা দরে বিক্রি করে। ডিলাররা কেজিতে ২ টাকা লাভ রেখে কৃষকের কাছে বিক্রি করতে পারেন। বিএডিসির রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক জানান, কোনো জেলাতেই সারের কোনো সঙ্কট নেই, কিছু অসাধু ডিলার কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেছে। তারা বাজার মনিটরিং করছেন, দ্রুতই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী সারের কোনো সঙ্কট নেই। বিএডিসি গুদামে পর্যাপ্ত সার মজুদ রয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার আশায় এ কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করছেন। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।

এদিকে, কৃষি বিভাগের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ডিলাররা। লালমনিরহাটের হারাটি ইউনিয়নের সার ডিলার আবু তাহের বলেন, সরকার যে পরিমাণ সার বরাদ্দ দেয়, আমরা নির্ধারিত দরে সেটি কৃষকের কাছে বিক্রি করি। কেউ বেশি দরে বিক্রি করে না। ডিলারের সার খুচরা বিক্রেতাদের কাছে কীভাবে যায়, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুচরা বিক্রেতারা কোথা থেকে সার পান, সেটা তাদের জানা নেই। লালমনিরহাট জেলা সার ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল হাকিম সঙ্কটের জন্য বরাদ্দের স্বল্পতাকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম থাকায় এ সঙ্কট তৈরি হয়। বিশেষ করে চরাঞ্চলে এখন প্রচুর জমিতে ফসল উৎপাদন হচ্ছে, ফলে সারের চাহিদাও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ২০০৯ সালের সার নীতি ঠিক রেখে চাহিদামতো সার সরবরাহ করলে সঙ্কট থাকবে না। তবে কোনো ডিলার যদি সত্যিই সারের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেন, তাহলে অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। রংপুর জেলা সার ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুল কাশেম জানান, বরাদ্দ কম হওয়ায় কিছুটা সঙ্কট তৈরি হয়েছে, আমরা আশা করছি দ্রুতই সঙ্কট দূর হবে। রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার শহিদুল ইসলাম বলেন, কোনো ডিলার যাতে অবৈধভাবে সার বিক্রি করতে না পারে, সেজন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক উপজেলায় অভিযান পরিচালিত হয়েছে। জরিমানাও করা হয়েছে ডিলারদের। কোথাও সারের কোনো সঙ্কট নেই।

লাইনে দাঁড়িয়েও সার পাচ্ছেন না কৃষক: জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে পৌর শহরের সদর রাস্তায় নান্নুর সারের দোকানে দেখা মিলেছে কৃষকদের দীর্ঘ লাইন। অনেকের হাতে রয়েছে বস্তা, ব্যাগ ও জাতীয় পরিচয়পত্র। জানা গেছে, শুধুমাত্র সোনামুখী ইউনিয়নের কৃষকদের সার প্রদান করা হবে। কেউ কেউ দূর থেকেও সার কেনার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। ডিলার ও কৃষি অফিস জানিয়েছে, কতটুকু সার এসেছে এবং কতটুকু দোকানে পৌঁছেছে তা যাচাইয়ের পরই অনুমতি দেয়া হবে।

সোনামুখী ইউনিয়নের কৃষক ইসমাইল হোসেন বলেন, সকাল থেকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু কিছু সার দেয়া হচ্ছে না। সার দোকানদার বলছে, কৃষি অফিস থেকে লোক এসে অনুমতি দিলে তবেই সার দেয়া হবে। কতটুকু সার পাবো তা দিয়ে পুরো জমিতে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে কি না, জানি না। সাবিনা হক অভিযোগ করেন, অন্যান্য জায়গায় ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে সার মজুত করছেন এবং বেশি দামে বিক্রি করছেন। বড় কৃষকরা কোনোভাবে টিকে থাকলেও ক্ষুদ্র কৃষকরা চরম বিপাকে পড়বে। সার ডিলার নান্নু জানান, এ মাসে ৮২৬ বস্তা ডিএপি (ড্যাপ) সার শুধু সোনামুখী ইউনিয়নে দেয়া হয়েছে। এখনও যত লোক সার চাচ্ছে, সঠিক মজুদ না থাকায় আরও দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রতি বিঘায় ডিএপি (ড্যাপ) সার সরকারি হিসেবে ২৭ কেজি বরাদ্দ থাকে। তবে জমি হিসাব করে বরাদ্দ পাওয়ায় সব সময় চাহিদা মিটছে না। কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, আপাতত অল্প করে সার ব্যবহার করুন এবং মাটি বেধে দেয়ার সময় আবার সার প্রয়োগ করুন। উপজেলা এলাকার অনেক জমি এখনও প্রস্তুত নয়, ফলে কৃষকরা পরে সার পাবেন কি না ভেবে এখনই নিকটস্থ ডিলারের কাছে ছুটছেন। উপজেলা কৃষি অফিসার ও কৃষিবীদ ইমরান হোসেন বলেন, নভেম্বর মাসে ডিএপি (ড্যাপ) সারের জন্য মোট ৫৩৩ মেট্রিক টন বরাদ্দ ছিল, যা ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।

ডিসেম্বর মাসের জন্য ৩৭৭ মেট্রিক টন বরাদ্দ নিশ্চিত করেছি। গতকাল উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তিনি আরও বলেন, চেষ্টা করছি আগামী ২৬ নভেম্বর বরাদ্দপত্র ঘোষণা যেন পাই। বরাদ্দপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিলাররা টাকা জমা দিলে ডিসেম্বরের ১ তারিখে সার মজুদ হবে। কৃষকরা জমিতে সার প্রয়োগ করতে না পারলে ভালো ফলন আশা করা যায় না। তাই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে এবং দ্রুত সার সরবরাহ বাড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।