শীতের শুরুতেই অতিথি পাখি শিকার নজরদারির অভাব প্রশাসনের
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: বৃহত্তর চলনবিল অঞ্চলে শীতের শুরুতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। এসব অতিথি পাখি ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির আবাসিক পাখি নির্বিচারে শিকার করা হচ্ছে। প্রকাশ্যে পেশাদার ও সৌখিন-উভয় শিকারির হাতে নির্বিঘ্নে ধরা পড়ছে পাখি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর শীত মৌসুমের শুরুতেই সুদূর সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন শীত প্রধান দেশ থেকে আসতে থাকে বালিহাঁস, চখাচখি, ল্যাঞ্জা, ইটালি, সরালিসহ নানা প্রজাতির পাখি। নিরাপদ আশ্রয় ও খাবারের খোঁজে এসব পাখি ছুটে আসে চলনবিলের বিভিন্ন জলাশয়ে।
এ বছরও শীতের শুরুতেই ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি আসছে। তাদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে চলনবিলের বিভিন্ন জলাভূমি। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার দীঘি সগুনা গ্রামের বাসিন্দা জুবায়ের হোসেন বলেন, ‘বিলে অতিথি পাখি আসার শুরুতেই কিছু সৌখিন ও পেশাদার শিকারি কারেন্ট জালসহ বিভিন্ন ফাঁদ পেতে অবাধে অতিথি পাখি শিকার করছে।
গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) পাখি শিকারের দায়ে স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে নাটোরে সিংড়া উপজেলার ইদ্রাসন, মাগুড়া ও ইটালি গ্রামের মাঠে অভিযান চালানো হয়। এসময় চার পাখি শিকারিকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাখি ধরার পাঁচ হাজার ফুট কারেন্ট জাল ও দুটি ফাঁদ জব্দ করা হয়। আটকদের মধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে দুইজনকে দুই মাসের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অপর দুইজনকে পাখি না মারার শর্তে মুচলেকায় ছেড়ে দেয়া হয়।
এসময় তাদের শিকার করা বিভিন্ন প্রজাতির ১০৫টি পাখি চলনবিলে অবমুক্ত করা হয়। কিন্তু তার পরও থেমে নেই পাখি শিকার। শিকারিরা পাখি শিকার করে প্রকাশ্যে বিক্রি করলেও প্রসাশনের নজরদারি নেই বললেই চলে। গতকাল বুধবার তাড়াশ উপজেলার বিনোদনপুর, বারুহাস, বিনসাড়া ও কুন্দইল বাজার ঘুরে দেখা গেছে প্রকাশ্যে পাখি বিক্রি করতে। এসময় স্থানীয়রা জানায়, প্রসাশনের ভয়ে বেশির ভাগ শিকারি ক্রেতাদের সঙ্গে আগে থেকেই গোপনে দামদর ঠিক করে রাখেন। শিকারের পরই তারা মোবাইল ফোনে ক্রেতাকে নির্দিষ্ট স্থানে ডেকে এনে পাখি বুঝিয়ে দেন।
এ কারণে এ এলাকায় পাখি বিক্রির একটি চোরাবাজারও রয়েছে। তবে কোনো কোনো এলাকায় সচেতন মানুষ পাখির অভয়াশ্রম তৈরিতে সহায়তা করার পাশাপাশি, কেউ যেন পাখিদের বিরক্ত না করে, সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখছেন। তাড়াশ উপজেলার উলিপুর ও নওগাঁর মথুরা দীঘি তার অন্যতম দৃষ্টান্ত।
উলিপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল খালেক বলেন, আমরা গ্রামবাসী সম্মিলিতভাবে পাখিগুলো পাহারা দিই। এ কারণে এ গ্রামে শত শত পাখির নিরাপদ আবাসস্থল থাকার পরও কেউ শিকার করার সাহস পায় না। নওগাঁ মথুরা দীঘিতে এ বছর অসংখ্য বালিহাঁস আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিবছর পাশের মরা করতোয়ায় এসব পাখি আশ্রয় নিত। কিন্তু গতবছর নদীটি অপরিকল্পিতভাবে খনন করায়, সেখান থেকে অতিথি পাখিরা সরে এসে মথুরা দীঘিতে ভীড় করছে। দিনভর পাখির ডাকে এলাকাটি মুখর থাকে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ভিলেজ ভিশনের নির্বাহী পরিচালক শরীফ খন্দকার বলেন, পাখিশিকারি, ক্রেতা, গ্রামের লোকজন একই সঙ্গে অসচেতন ও চালাক। অন্যায় জেনেও তাঁরা এ কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, তারা কখনও দিনে, কখনও রাতে পাখি শিকার করে স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি করছে। সৌখিন শিকারীরা অতিথি পাখির পাশাপাশি গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে অবাধে দেশি পাখিও শিকার করে থাকে।
এ বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনের আহ্বান জানান তিনি। সরকারিভাবে অতিথি পাখি শিকার ও বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় শিকারীরা ইচ্ছামতো পাখি শিকার ও বিক্রি করছে বলে মন্তব্য করেন ভিলেজ ভিশনের নির্বাহী পরিচালক।
তাড়াশ উপজেলা বন কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বলেন, বেশিরভাগ শিকারি রাতে পাখি শিকার করেন। সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুসরাত জাহান বলেন, শিকারিদের অবস্থান জেনে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করে, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে তাড়াশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউর রহমান বলেন, দ্রুত চলনবিলের হাটবাজারে যৌথ অভিযান চালিয়ে পাখি শিকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।










