আমন ধান ঘরে তুলতে উৎসবে মেতেছে কৃষান-কৃষাণি
উত্তরাঞ্চলজুড়ে ভালো ফলন:
স্টাফ রিপোর্টার: প্রকৃতিতে এখন হেমন্তকাল। দিনের শুরুতে কুয়াশা ভেদ করে যখন সূর্য্যরে আলো প্রকৃতিতে আসে, তখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে দিগন্ত বিস্তৃত আমন ধানের খেত। সোনামাখা রোদে মাঠে-মাঠে সোনালি ধান আরও ঝলমলিয়ে ওঠে। সেই ধানের ঝিলিক ছড়িয়ে পড়েছে ধান-চাল উৎপাদনে প্রসিদ্ধ অঞ্চল উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের চোখেমুখে।
সম্প্রতি উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় শুরু হয়েছে আমন ধান কাটা ও মাড়াই। এবার রাজশাহী জেলায় আমনের ফলন হয়েছে ভালো। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছেন চাষিরা। এ নিয়ে হাসি ফুটেছে তাদের মুখে। সময়মতো বৃষ্টি, অনুকূল আবহাওয়া, কম খরচে বেশি ফলন হওয়ায় লাভের আশা করছেন তারা। রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, সময়মতো সার, বীজ, কীটনাশক ও সেচ সুবিধা নিশ্চিত হওয়ায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী, তানোর, পবা, মোহনপুর, বাগমারা, দুর্গাপুর ও চারঘাট উপজেলার মাঠজুড়ে এখন সোনালি ধানের হাওয়ায় মুখর গ্রামাঞ্চল। মাঠে মাঠে চলছে ধান কাটার উৎসব। চাষিরা বলছেন, এবার আবহাওয়া ছিল অনুকূলে, সময়মতো বৃষ্টি হওয়ায় সেচ খরচ কম পড়েছে। ফলে আগের বছরের তুলনায় উৎপাদনও ভালো। তবে শেষ সময়ের বৃষ্টিতে কিছু চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে তা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলায় ৮৩ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে।
যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ১৭ হাজার ৪৯০ মেট্রিক টন। গত বছর চাষ হয়েছিল ৮৪ হাজার ১০৫ হেক্টর জমিতে, উৎপাদন হয়েছিল তিন লাখ ১৮ হাজার ৩২৩ মেট্রিক টন। তবে শেষ সময়ে টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণে সামান্য ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। কৃষক ও কর্মকর্তাদের মতে, সময়মতো আবহাওয়ার অনুকূলতা বজায় থাকলে চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে আমনের বাম্পার ফলন হবে। যা জেলার খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অগ্রহায়ণের শুরু থেকেই রাজশাহী ও নওগাঁর বিভিন্ন গ্রামের মাঠে-মাঠে ইতিমধ্যেই ধান-কাটার ধুম পড়েছে। ফসলের মাঠে মাঠে সরব কৃষক-কৃষাণি ও কৃষি শ্রমিকেরা। ধানের ম-ম গন্ধ এখন কৃষকের উঠানজুড়ে। নতুন ধান ঘরে ওঠায় বাড়িতে বাড়িতে চলছে নবান্নের উৎসব। অগ্রহায়ণ মাসে ঘরে প্রথম ধান তোলার পর নতুন চাল দিয়ে উৎসবটি পালন করেন কৃষিজীবীরা। নতুন ধান ঘরে উঠতেই সাধারণত গ্রামের কৃষানিরা সেই ধান থেক চাল তৈরির কাজে লেগে পড়েন। নতুন ধানের চাল দিয়ে কৃষকের বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হচ্ছে ক্ষীর-পায়েস, কিংবা সেই চালের গুড়ায় তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের সুস্বাদু পিঠা। ক্ষীর-পায়েস আর পিঠা বানিয়ে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের আপ্যায়ন করিয়ে থাকেন।
সাধারণত কৃষকের বাড়িতে হওয়া এই আনন্দঘন মূহূর্তকেই নবান্ন উৎসব বলা হয়ে থাকে। আবার অনেক জায়গায় নতুন ধান ওঠা উপলক্ষে গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। সাধারণত পুরো অগ্রহায়ণজুড়ে এবং পৌষের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত গ্রামীণ জনপদের মাঠঘাট, উঠান মুখর থাকে কিষান-কৃষানিদের ফসল তোলার উৎসবে। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় নিয়ামতপুর উপজেলায় আমনের ফলন হয়েছে ভালো। প্রাকৃতিক বিপর্যয় না থাকায় গতবারের মতো বাম্পার ফলনের আশা করছে কৃষি বিভাগ। তবে আমন ওঠার শুরুতেই ধানের দাম কম থাকায় কৃষকেরা কিছুটা হতাশ। তাঁদের প্রত্যাশা, মৌসুমের শুরুতে দাম কিছুটা কম থাকলেও সরকারি গুদামে ধান সংগ্রহ অভিযান পুরোদমে শুরু হলে খোলাবাজারেও ধানের ন্যায্যমূল্য পাবেন কৃষকেরা।
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার দেবীপুর গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান চলতি মৌসুমে দুই বিঘা জমিতে বিনা-১৭ ধান চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে ধান কাটা শুরু করেছেন এবং আশা করছেন বিঘাপ্রতি ২০-২২ মণ ধান পাবেন। ধানের দাম আশানুরূপ থাকলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন। তিনি বলেন, এবার জমিতে পানি দেওয়া লাগেনি বললেই চলে। এতে খরচও অনেক বেচে গেছে। ধানের দাম পেলে লাভ বেশি হবে। গোদাগাড়ী উপজেলার ঘিয়াপুকুর গ্রামের কৃষক লুৎফর রহমান বলেন, এ বছর পানি নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু আল্লাহর রহমতে ঠিক সময়ে বৃষ্টি হয়েছে। ফলে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তবে শেষ সময়ের বৃষ্টি চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। এতে ধান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আশা করি কিছুটা লাভ করতে পারবো।
তানোর উপজেলার চিমনা গ্রামের কৃষক সানাউল্লাহ বলেন, গতবার সেচে অনেক খরচ পড়েছিল। এবার প্রকৃতির আশীর্বাদে তেমন খরচ হয়নি। ফলনও ভালো হয়েছে। আশা আছে ধানের দাম পেলে লাভ পাবো। একই কথা বলেছেন চারঘাট উপজেলার হাবিবপুর গ্রামের কৃষক আবদুর রহিমন রহিম। তিনি জানান, গত কয়েক বছর বিভিন্ন কারণে আমন চাষের ফলন কম ছিল। কিন্তু এ বছর আবহাওয়া অনুকূল ছিল এবং কীট-পতঙ্গ তেমন ছিল না, এ কারণে ফলন ভালো হয়েছে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, এবার শেষ সময়ে বৃষ্টিতে কিছু জায়গায় ক্ষতি হলেও সামগ্রিকভাবে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তেমন প্রভাব ফেলবে না। বিভিন্ন উপজেলায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভালো হবে বলে আশা করছি।











