সংবিধানে ফিরল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা
চতুর্দশ নির্বাচন থেকে কার্যকর:
সোনালী ডেস্ক: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে রায় ঘোষণা করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে এই রায় চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ এই রায় ঘোষণা করেন। আপিল বিভাগের অপর ছয় সদস্য হলেন বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
এদিকে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল নিয়ে আপিল বিভাগের রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রকাশ করেছেন আদালত। রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়েছে, আপিলসমূহ সর্বসম্মতভাবে মঞ্জুর করা হলো এবং সিভিল রিভিউসমূহ সেই আলোকে নিষ্পত্তি করা হলো। আদালত এই মর্মে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে পর্যালোচনাধীন আপিল বিভাগের রায়টি নথি দৃষ্টে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান একাধিক ত্রুটিতে ত্রুটিপূর্ণ। অতত্রব, পর্যালোচনাধীন রায়টি এতদ্বারা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হলো। ফলশ্রুতিতে, সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছেদ ২ক-এর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত বিধানাবলী, যা সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬ (১৯৯৬ সনের ১ নং আইন) এর ধারা ৩ দ্বারা সন্নিবেশিত হয়েছিলো, তা এতদ্বারা এই রায়ের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো। যদিও এইরূপ পুনরুজ্জীবন পরিচ্ছেদ ২ক-এ বর্ণিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিধানাবলীর স্বয়ংক্রিয় পুনঃস্থাপন নিশ্চিত করে, তবে পুনরুজ্জীবিত অনুচ্ছেদ ৫৮খ (১) এবং অনুচ্ছেদ ৫৮গ (২) এর বিধানাবলীর প্রয়োগ সাপেক্ষে উহা কার্যকর হবে। পুনঃস্থাপিত ও পুনরুজ্জীবিত পরিচ্ছেদ ২ক-এ বর্ণিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিধানাবলী কেবলমাত্র উক্তরূপ ভবিষ্যত প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতেই কার্যকর হবে। মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় পরে প্রদান করা হবে বলে সংক্ষিপ্ত রায়ে জানানো হয়েছে।
এর আগে গত ২১ অক্টোবর নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে আপিলের শুনানি শুরু হয়। পরে গত ২২ অক্টোবর নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে আপিলের দ্বিতীয় দিনের শুনানি শেষ হয়। এ দু’দিন রিটকারী বদিউল আলম মজুমদারের পক্ষে শুনানি শেষ করেন আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া। এরপর গত ২৩ অক্টোবর তৃতীয় দিনের মতো মামলাটির শুনানি হয়। গত ২৮ অক্টোবর নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে আপিলের চতুর্থদিনের শুনানি করেন জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। এরপর গত ২৯ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে আপিলের ৫ম দিন, গত ৩ ও ৪ নভেম্বর ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম দিনের মতো শুনানি করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। ৯ম দিন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান। পরে গত ১০ দিনের মামলার সব পক্ষের আবেদনের শুনানি শেষে গত ১১ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ রায়ের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার রায়ের দিন ধার্য করেন।
গত ২৭ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ। পুনরায় এ বিষয়ে আপিল শুনবেন বলে জানান আদালত। এরই ধারাবাহিকতায় মামলাটি শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন। সেদিন আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান শুনানি করেন। শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে দিয়ে সাময়িক সমাধান দিতে চায় না আপিল বিভাগ। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কার্যকর সমাধান চায় আপিল বিভাগ। যাতে এটি বারবার বিঘ্নিত না হয়। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে এটি যাতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখে, সেটিই করা হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে দিলে তা কখন থেকে কার্যকর হবে সে প্রশ্নও রেখেছিলেন প্রধান বিচারপতি। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছিলেন, গেলো দেড় দশকে দেশের মানুষ শাসিতের পরিবর্তে শোষিত হয়েছে নানাভাবে। মানুষ গুম খুন বিচার বহির্ভূত হত্যা ও রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এগুলো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যেসব সিস্টেম ছিল সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে এবং মানুষ বিচার পায়নি। যার কারণে এই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। আর সেই রাজপথ থেকেই নির্ধারিত হয়েছে কে প্রধান বিচারপতি হবেন আর কে সরকার প্রধান হবেন। জনগণের এই ক্ষমতাকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই।
এসব অবজ্ঞা করলেই বিপ্লবের সৃষ্টি হয়। এসময় তিনি ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ। পাশাপাশি পুনরায় এ বিষয়ে আপিল শুনানীর জন্য ২১ অক্টোবর দিন নির্ধারণ করা হয়। প্রসঙ্গত, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে অ্যাডভোকেট এম. সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট রুল জারি করেন। তবে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট চূড়ান্ত শুনানি শেষে রিটটি খারিজ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করা হয়। আদালত এ মামলায় আট জন অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ করে তাদের মতামত শোনেন। এদের মধ্যে পাঁচ জন সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। তারা হলেন- ড. কামাল হোসেন, টিএইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ।
অপর অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেসি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মত দেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও ড. এম জহির তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পক্ষে মত দিয়ে তাদের প্রস্তাব আদালতে তুলে ধরেন। এছাড়া তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দেন। এরপর আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং ৩ জুলাই গেজেট প্রকাশিত হয়। এরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। তবে এরই মধ্যে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বর্তমানে নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়। সরকার পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট প্রথম আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তি।
বাকিরা হলোন- তোফায়েল আহমেদ, এম. হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভুঁইয়া ও জাহরা রহমান। এরপর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একই বছরের ১৬ অক্টোবর এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার গত বছরের ২৩ অক্টোবর পৃথকভাবে পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। এছাড়া নওগাঁর রানীনগরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেনও একই ধরনের আবেদন জানান। ফলে রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিগতভাবে মোট চারটি রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানিতে ওঠে। সেসব আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ২৭ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ। পুনরায় এ বিষয়ে আপিল শুনবেন বলে জানান আদালত। এরই ধারাবাহিকতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত মামলাটি পুনরায় আপিল বিভাগের শুনানিতে ওঠে। উল্লেখ্য, এর আগে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে দেশে সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। আর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে।









