ঢাকা | নভেম্বর ২১, ২০২৫ - ২:২৫ পূর্বাহ্ন

রাজশাহীতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সিজার

  • আপডেট: Thursday, November 20, 2025 - 9:22 pm

প্রতি দশজনের ৪ শিশুর জন্ম সিজারে:

স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহী বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে অস্ত্রোপচারের (সিজার) মাধ্যমে সন্তান প্রসবের প্রবণতা। বর্তমানে প্রতি দশজনের চারজন শিশু এখন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নিচ্ছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ন্যাচারে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বিভাগে সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতি দশটি প্রসবের মধ্যে প্রায় চারটি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হচ্ছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) মতে, জরুরি প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।

রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ৩৯৩ জন প্রসূতি মায়ের ওপর করা জরিপের ভিত্তিতে গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একদল গবেষক। গবেষক দলের প্রধান ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রী রোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবেদা খাতুন বলেন, গবেষণায় তারা রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার সরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করেছেন। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে গড়ে ৪১ শতাংশ প্রসূতি অস্ত্রোপ্রচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এ হার সবচেয়ে বেশি নওগাঁ জেলায় যেখানে গড়ে প্রতি ১০০ জন প্রসূতির ৪৫ জন অস্ত্রোপচারের সন্তান জন্ম দিয়েছেন।

গবেষকরা বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি হাসপাতালগুলোতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসবের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ফলে বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে এর ব্যবধান দ্রুত কমে আসছে। এমনকি কিছু উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অস্ত্রোপচারের সংখ্যা এখন বেশি। গবেষণায় বলা হয়, ২৪ ঘণ্টা প্রসূতি সেবা দিতে জনবল সংকট, স্বাস্থ্যজনিত জটিলতার আশঙ্কা, এবং চিকিৎসকদের মধ্যে নিরাপদ ও দ্রুত বিকল্প হিসেবে অস্ত্রোপচার বেছে নেওয়ার প্রবণতা- এ তিনটি কারণে অস্ত্রোপ্রচারের হার বাড়ছে।

এছাড়া ৩১ বছর বা তার বেশি বয়সি প্রসূতি, উচ্চশিক্ষিত নারী এবং নিম্নআয় পরিবারভুক্ত নারীদের মধ্যে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসবের হার তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া গেছে। গবেষকরা এটিকে মাতৃস্বাস্থ্যসেবায় আর্থসামাজিক বৈষম্যের প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন। অবাক করার বিষয় হলো, জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রবণতার বিপরীতে রাজশাহীতে নিম্নআয়ের পরিবারের নারীরা অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের বেশি শিকার হচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে স্বাস্থ্যসচেতনতার অভাব, সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তারের অক্ষমতা এবং কিছু বেসরকারি বা আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বার্থ।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যেসব নারীর স্বামী কৃষি বা সেবা খাতে কর্মরত এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা কম, তাদের ক্ষেত্রেও অস্ত্রোপচারের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সম্প্রতি সিজারিয়ান প্রসব করা কয়েকজন নারী জানান, তারা চিকিৎসকের পরামর্শের ওপর নির্ভর করে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের প্রধান আবেদা খাতুন বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতেও যখন বেসরকারি খাতের মতো সিজারিয়ানের হার বাড়ে, তখন বোঝা যায় চিকিৎসা-সুবিধার চেয়ে প্রতিষ্ঠানিক সুবিধা বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

তিনি বলেন, অস্ত্রোপচার শুধু মায়ের শারীরিক ঝুঁকি বাড়ায় না বরং তার পরিবারের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। তিনি সরকারি হাসপাতালে প্রসব কার্যক্রমে কঠোর তদারকি নিশ্চিত করা এবং শুধু চিকিৎসাগত জরুরি প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করার নির্দেশনা বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, যথাযথ হস্তক্ষেপ না নিলে ক্রমবর্ধমান সিজারিয়ান প্রবণতা এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মাতৃ ও নবজাতক মৃত্যুহার হ্রাসের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। গবেষণায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল উভয়খাতে প্রসব সিদ্ধান্তে কঠোর নজরদারি, মিডওয়াইফদের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং নিরাপদ ও প্রমাণভিত্তিক মাতৃত্বসেবা বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে।