ঢাকা | নভেম্বর ১৭, ২০২৫ - ১:০১ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম

নবান্ন উৎসব: রাজশাহীর মাঠে-মাঠে ধান কাটা শুরু

  • আপডেট: Sunday, November 16, 2025 - 10:20 pm

স্টাফ রিপোর্টার: মাঠভরা সোনালি ধানের ওপর ছড়িয়ে পড়ছে বিকেলের সূর্যের মিষ্টি আলো। ধানখেতের পাশে নারীদের কয়েকটি দল নতুন শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবার হাতে কাস্তে। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অতনু সরকার রেফারির মতো সামনে দাঁড়িয়ে বললেন-ওয়ান, টু, থ্রি। সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হলো কিষানিদের ধান কাটার প্রতিযোগিতা। বেশ খানিকটা জমির আমন ধান মুহূর্তেই কাটা শেষ।

রোববার পয়লা অগ্রহায়ণে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুরে নবান্ন উৎসবে এমন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। রাজশাহী শহরের মহিষবাথান এলাকার কৃষক মনিরুজ্জামান মনির এ গ্রামে জমি ইজারা নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষাবাদ করছেন। একাধিকবার জাতীয় কৃষি পদকও পেয়েছেন। তাঁর উদ্যোগেই সাত বছর ধরে গ্রামে এই উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। বরাবরের মতো এবারও এই আয়োজনে পুরো গ্রামের মানুষ অংশ নেন।

প্রথমেই গ্রামের শিশু-কিশোরীরা গাঁদা ফুল ছিটিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেয়। পরে জাতীয় সংগীতের পর শুরু হয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের ধান কাটার প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় ওরিনা লাকড়ার দল। এবার প্রথম নয়, টানা পাঁচ বছর ধরেই প্রথম হচ্ছে তাঁর দল। আগে পাঁচজনের দল হতো। দুই বছর ধরে তিনজন করে। এবার ওরিনার সঙ্গে ছিলেন বিমলা বেগ ও স্বপ্না লাকড়া। প্রথম হয়ে তাঁরা বললেন, ধান কাটতে কাটতে হাত চালু হয়ে গেছে। তাই আমরাই পাঁচ বছর ধরে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে আসছি।

নবান্ন উৎসব উপলক্ষে এবারও গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে পিঠাপুলি আর পায়েস রান্না করা হয়। এক মাস আগে থেকে গ্রামের কিশোরীরা নাচ অনুশীলন করে রাখে। বিকেলে ধান কাটার প্রতিযোগিতার পর একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে কিশোরীরা নৃত্য পরিবেশন করে। অনুষ্ঠানে মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য রাজশাহীর পবার বিলকিস বানু ও বগুড়ার সুরাইয়া ফারহানা রেশমাকে নবান্ন সম্মাননা দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. মোহা. ফরিদ উদ্দীন খান, রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক মেহেরুন নেসা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম। তাঁরা প্রায় হারাতে বসা এ নবান্ন উৎসব দেখে অভিভূত হন। এ ধরনের আয়োজন করার জন্য তাঁরা কৃষক মনিরুজ্জামানকে ধন্যবাদ জানান। অনুষ্ঠানে মনিরুজ্জামান জানান, কর্মব্যস্ত প্রতিটা দিনের মাঝে একটা দিন সবাইকে একটু বিনোদন দিতেই এই আয়োজন। তিনি যত দিন এ গ্রামে থাকবেন, তত দিন আয়োজন করবেন এই উৎসব।

নবান্নের পিঠার সুবাসে মুখর রাবি:

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কৃষি অনুষদ চত্বরে শীতের হিমেল ভোরে ছড়িয়ে পড়েছিল পিঠাপুলির ঘ্রাণ। ‘হিম হিম শীতের বাতাস, উষ্ণতায় ছড়ায় পিঠা পুলির সুবাস’ প্রতিপাদ্যে রোববার প্রাণবন্ত নবান্ন ও ‘পিঠা উৎসব ১৪৩২’- এর আয়োজন করে এগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচার এক্সটেনশন সমিতি। দিনের শুরুতে সকাল ৯টায় ধান কেটে উৎসবের উদ্বোধন করা হয়।

নতুন ধান ঘরে তুলেই নবান্ন উদযাপনের যে বৈচিত্র্যময় গ্রামীণ ঐতিহ্য, তারই এক দৃষ্টিনন্দন প্রতিফলন দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ চত্বরে। এরপরই শুরু হয় পিঠার বর্ণিল আয়োজন যেখানে জড়ো হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অসংখ্য মানুষ। প্রতি বছরের মতো এবারও উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা খাওয়া, নাচ-গান, আনন্দ-উল্লাসে পুরো অনুষদ প্রাঙ্গণ সরগরম হয়ে ওঠে। অনুষদের সামনে থেকে বের হওয়া বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। এবারের পিঠা উৎসবে ছিল শিক্ষার্থীদের তৈরি প্রায় দেড় শতাধিক পদের পিঠা।

বিভিন্ন স্টলে সাজানো ছিল দুধপুলি, চন্দ্রপুলি, নারকেল পুলি, তেলপিঠা, নকশী পিঠা, দুধচিতই, শামুক পিঠা, জামাই পিঠা, পাটি সাপটা, গোলাপ ফুল, সুজির বড়া, মালাই বিহার, ডাবের পুডিং, রূপালি পিঠা, বুটের বরফি, মোহনভোগ, ডিম সুন্দরী, মাছের পিঠা, গাজরের হালুয়া, খিরপুলিসহ আরও অনেক। এত বৈচিত্র্যময় পিঠার সমাহার যেন একদিনের জন্য কৃষি অনুষদকে পরিণত করেছিল শীতের গ্রামীণ স্বাদবাজারে। মাত্র ১০ টাকা থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন দামের এসব পিঠা কিনতে উৎসবে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।

পিঠার স্বাদ যেমন আনন্দ দিয়েছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল আয়োজন মুগ্ধ করেছে সবাইকে। এগ্রোনোমি অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের শিক্ষার্থী জেরিন জেবা বলেন, নবান্ন উৎসব আমাদের বিভাগের একটি ঐতিহ্য। নতুন ধান উঠলে ঘরে পিঠা তৈরি করার যে সংস্কৃতি, আমরা সেটাকেই ধারণ করি। এই উৎসব আমাদের সংস্কৃতির শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত রাখে। বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নবান্ন আমাদের কৃষি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিক্ষার্থীদের এমন প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ দেখে আমরা উৎসাহ পাই।