ঢাকা | নভেম্বর ১৭, ২০২৫ - ৪:৫২ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম

চরবাসীর যাপিত জীবন ও নারীদের লড়াই

  • আপডেট: Sunday, November 16, 2025 - 10:00 pm

রফিকুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ থেকে: হেমন্ত গড়িয়ে শীতের আগমণী বার্তা প্রকৃতিতে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে এক সময়ের প্রমত্ত যমুনা এখন তার জৌলুশ হারিয়েছে। তার বুকে জেগে উঠেছে অনেক চর। আর সেই জেগে ওঠা পলিসমৃদ্ধ চরে এখন চলছে নতুন করে ফসল ফলানোর কর্মযজ্ঞ। কাজিপুরের যমুনা চরের সংগ্রামী মানুষ প্রকৃতির সাথে লড়াই করেই টিকে আছে বছরের পর বছর। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তারা চর ছাড়ে না।

এছাড়াও সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে লড়াই করছে ভাঙনকবলিত যমুনার চরের কয়েক হাজার নারী। যে হাত এক সময় গৃহাস্থলী কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেই হাত এখন কাস্তে, কোদাল চালাতেও পারদর্শী হয়ে উঠেছে। চরের উর্বর পলিসমৃদ্ধ মাটির বুকে ফলাচ্ছে শাকসবজি ও সোনালী ফসল। বরং যমুনার তাণ্ডবকে জয় করে তার বুকে জেগে ওঠা চরে ধান, গম, সরিষা, তিল, তিশি, কাউন, মরিচ, ভুট্টা, বাদাম, সবজিসহ নানা শীতকালীন আবাদ করে। কোনটির আবাদ এরই মধ্যে শুরু করেছেন।

নদীর টানেই কাজিপুরের যমুনার চরে অবস্থিত ছয়টি ইউনিয়নের পৌণে দুই লাখ মানুষ আশায় বুক বেঁধে পড়ে থাকে ভাঙা জীর্ণ কাইশার (কাশ) ছাউনিওয়ালা ঘরে। যে যমুনা তাদের বছরের পর বছর সর্বস্ব গ্রাস করেছে সে নদীই একদিন হয়তোবা ফিরিয়ে দেবে বাপ-দাদার জমি-জিরাত। বুক ভরা আশা, যদি হারিয়ে যাওয়া জোতজমি আবার জেগে ওঠে। এই আশা নিয়ে বর্ষা-বন্যা- ভাঙন-ঝড় বাদল মাথায় নিয়ে নদী আর প্রকৃতির সাথে লড়াই করছে চরের মানুষ। শত দুঃখ যন্ত্রণা আর অভাব-অনটন নিয়ে চরের মাটিকেই আঁকড়ে ধরে আছে। বর্ষাকালে যমুনা নদীর উত্তাল স্রোতোধারার সাথে উজান থেকে পানির সাথে নেমে আসে উর্বর পলি। শুষ্ক মৌসুমে জেগে ওঠা সেই নরম পলি চরবাসীর কাছে সোনার মতই দামী। যেন আশীর্বাদ।

গত দুই সপ্তাহ যাবৎ কাজিপুরের চরাঞ্চলের কৃষকদের ফুরসত নেই। দু’হাতে পরম মমতায় তারা চরের পলি সমৃদ্ধ মাটিতে বাদাম, ভুট্টা, মরিচ, সরিষাসহ নানা ধরনের সবজির বীজ বপনে ব্যস্ত সময় পার করছেন। জমিতেই তারা সকাল এবং দুপুরের খাবার খায়। চরের দিনমজুরেরা কাজের সন্ধানে ছুটে চলে এক চর থেকে আরেক চরে। এরইমধ্যে জেগে ওঠা চরে লাগানো রোপা আমন কেটে জমিতেই মাড়াই করে ঘরে তুলছে কেউ কেউ। কেউবা চরের কাইশা কেটে চরেই শুকিয়ে আঁটি বেঁধে নৌকায় বিক্রির উদ্দেশে নিয়ে যাচ্ছে। চরবাসীর পরিবহনের জন্য পানিতে নৌকা আর মাটিতে ঘোড়ার গাড়ি, ভ্যানগাড়ি, আর কাঁধের ভারই একমাত্র ভরসা।

নাটুয়ারপাড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের জানান, চরের প্রতিটি মানুষই কোন না কোনভাবে যমুনার ভাঙনের শিকার। আমাদের অনেকেই দশ থেকে বারোবার পর্যন্ত বাড়ি সরিয়েছে। তারপরও আমরা চরেই পড়ে আছি। এতো প্রতিকূলতার পরও চরে যে ফসল ফলে তা অন্য কোথাও এতো সহজে ফলানো যায় না। এর ফলে চরের মানুষ চর ছাড়ে না। ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থাসহ সরকার তাদের জীবন মান উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে- এমনটিই দাবি চরবাসীর।

এদিকে, সরেজমিনে গত শুক্রবার বিকালে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া চরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কৃষিকাজে নিয়োজিত অসংখ্য নারী। পুরুষের পাশাপাশি জমিতে বাদাম লাগাচ্ছেন তারা। একটি জমিতে গিয়ে দেখা মেলে রেহাইশুড়িবেড় চরের রেহানা মজিদ দম্পতির। জমি প্রস্তুত করে তারা ভুট্টা লাগাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে কাজ করছেন আরো কয়েকজন নারী শ্রমিক। এ সময় রেহানা বলেন, ‘ও (স্বামী) একা কাজ করে সারতে পারে না। বাড়তি টাকাও নাই যে কামলা নিয়া কাজ করামু। বাধ্য হয়া আমি কয়েক বছর ধইরা দুইজন মিলা জমিতে কাজ করি।’ এরই মধ্যে তিন বিঘা জমিকে ভুট্টা লাগিয়েছেন এই দম্পতি। তার মধ্যে এক বিঘা নিজের। বাকি দুই বিঘা কট (বন্ধক) নিয়েছেন।

রেহানাদের জমিতে দিনমজুরির কাজ করছেন ময়না খাতুন (৩২) নামের এক নারী। তিনি বলেন, ‘ মেয়েকে কলেজে দিছি এবার। ম্যালা খরচ। এক ছেলে হাইস্কুলে যায়। ওদের রিকশাচালক বাবায় একলা কাম কইরা যা পায়, তাতে সংসার চলা কঠিন। তাই আমার প্রতিবেশী রেহানাদের জমিতে কাজ করতাছি। কাজ বুঝে দিনে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পাই।’ এখন সংসার কেমন চলছে- জানতে চাইলে আত্ম প্রত্যয়ের সঙ্গে ময়না বলেন, ‘দুইজনের আয়ে সংসার ভালোই চলছে এহন। আগেতো ম্যালা কষ্ট করা লাগছে। শরম কইরা কী হইবো। কাজ কইরা খাই। ভিক্ষাতো করি না।’

চলনবিলের শুটকি যাচ্ছে দেশ-বিদেশে

বন্যার পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৎস্যভাণ্ডারখ্যাত চলনবিল এলাকার তাড়াশ ও উল্লাপাড়ায় শুটকি তৈরির ধুম পড়ে গেছে। শুটকি উৎপাদনের লক্ষ্যে এ অঞ্চলের তিন শতাধিক চাতালে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রতি বছরের মতো এবারও শুরু হয়েছে দেশীয় প্রজাতির মাছ দিয়ে শুটকি তৈরির প্রক্রিয়া। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি মৌসুমে প্রায় ২৭৫.৮০ মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। শুটকি ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, প্রতিমণ কাঁচা মাছ ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় কেনা হয়। তাড়াশের ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ৩ কেজি কাঁচা মাছ থেকে প্রায় ১ কেজি শুটকি তৈরি হয়। উৎপাদিত শুটকি মাছ প্রকারভেদে ১২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা মণ দরে পাইকারি বিক্রি করা হয়।

ব্যবসায়ীরা জানান, বর্ষা মৌসুমে চলনবিলে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। সকাল বা বিকালে স্থানীয় আড়ত থেকে এসব মাছ কিনে এনে চাতালে শুকিয়ে শুটকি তৈরি করা হয়। চলতি বছর অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে শুটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। এ অঞ্চলের প্রতিটি চাতালে ১০ থেকে ১৫ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করছেন, যার মধ্যে নারীরাই বেশি দক্ষ বলে জানা গেছে। চলনবিলে শুটকি তৈরির কাজ শুরু হলেও বাজারজাত হতে আরও মাসখানেক সময় লাগবে। শুকনো মৌসুমে এসব শুটকি দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়। স্থানীয় পাইকাররা জানান, এখানকার উৎপাদিত শুটকির বেশিরভাগই সৈয়দপুর আড়তে যায়।

তাড়াশ এলাকার শুটকি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম ও মোফাজ্জল হোসেন জানান, এবার শুটকি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চলনবিলে যত্রতত্র পুকুর খনন এবং বন্যা কম হওয়ায় পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। তারা বলেন, গত বছর ৩০ থেকে ৩২ মেট্রিক টন শুটকি তৈরি হলেও এবার ১০ থেকে ১২ মেট্রিক টনের বেশি উৎপাদন সম্ভব নয়। চাতালের নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, তারা চরম মজুরি বৈষম্যের শিকার। একজন নারী শ্রমিক দিনে ২৫০ টাকা পান, যেখানে পুরুষ শ্রমিকদের মজুরি ৫০০ টাকা এবং তিন বেলা খাবার দেয়া হয়। কিন্তু নারী শ্রমিকদের কোনো খাবার দেয়া হয় না।

উল্লাপাড়া উপজেলার বড়পাঙ্গাসীর হাছেন আলী বলেন, বর্ষাকালে মাছের আমদানি বেশি হয়। এলাকার হাট-বাজার থেকে মাছ কিনে এনে তারা শুটকি তৈরি করেন। এখানকার শুটকি মাছ সৈয়দপুর, জয়পুরহাট, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন মোকাম বাজারে পাইকারি বিক্রি হয়। চাতালের নারী শ্রমিক হাফিজা ও শাহিনুর জানান, সংসারের বাড়তি আয়ের জন্য তারা মাছ বাছাইয়ের কাজ করেন। দিনে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা মজুরি পান।

তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোকারম হোসেন বলেন, ইতিমধ্যেই শুটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে এ বছর মাছের সরবরাহ আগের তুলনায় কিছুটা কম। তিনি জানান, চলতি মৌসুমে ৭০ থেকে ৮০ মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। উল্লাপাড়া উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আতাউর রহমান জানান, বর্তমানে এখানে ৩০৩৫টি চাতালে শুটকি উৎপাদন চলছে। প্রতিবছর এ উপজেলায় প্রায় ৮০ থেকে ১০০ মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদিত হয়। এখানকার শুটকির চাহিদা দেশের বিভিন্ন মোকাম বাজারে রয়েছে। উৎপাদিত শুটকি ঢাকা ও নীলফামারীতেও পাঠানো হয়। সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানান, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত শুটকি উৎপাদনের জন্য ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে এবং নিয়মিত মনিটরিং চলছে। সিরাজগঞ্জের শুটকির চাহিদা শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও রয়েছে। এখানকার শুটকি নীলফামারী আড়ত হয়ে ভারতসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়।