ঢাকা | নভেম্বর ১৪, ২০২৫ - ১১:৫৬ অপরাহ্ন

শিরোনাম

রাজশাহীতে ছেলে খুনের ঘটনায় মামলা করলেন বিচারক

  • আপডেট: Friday, November 14, 2025 - 10:00 pm

বিচারকদের নিরাপত্তাসহ ২ দাবি:

স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ আব্দুর রহমান ছেলে তাওসিফ রহমান সুমনকে (১৬) খুনের ঘটনায় মামলা করেছেন।

শুক্রবার দুপুরে তিনি মামলার এজাহারে সই দিয়ে ছেলের লাশ নিয়ে জামালপুরের গ্রামের বাড়ি রওনা হন। পরে রাজপাড়া থানা-পুলিশ মামলাটি রেকর্ড করে। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) মুখপাত্র গাজিউর রহমান বিকেলে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

আরএমপির মুখপাত্র বলেন, বিচারক নিজে বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলার একমাত্র আসামি লিমন মিয়া (৩৪)। তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। পুলিশ হেফাজতে হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসা শেষে তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে।

আসামি লিমন মিয়া গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার মদনেরপাড়া ভবানীগঞ্জ গ্রামের এস এম সোলায়মান শেখের ছেলে। তিনি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য ও ফুলছড়ি উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। লিমন সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে চাকরি করতেন। ২০১৮ সালে তাঁর চাকরি চলে যায়। এরপর থেকে তিনি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কয়েক বছর আগে বিয়ে করেছিলেন লিমন। তবে সংসার টেকেনি। বিচারক আব্দুর রহমানের স্ত্রী তাসমিনা নাহার লুসীর (৪৪) সঙ্গে তাঁর পূর্বপরিচয় ছিল। তাঁর কাছ থেকে লিমন টাকা নিতেন।

পুলিশের ভাষ্য, টাকা দেয়া বন্ধ করে দিলে নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করে আসছিলেন লিমন। দিয়েছিলেন প্রাণনাশের হুমকিও। এ নিয়ে ৬ নভেম্বর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন তাসমিনা। বিচারক আব্দুর রহমান এক বছর আগে শ্রম আদালতের বিচারক হয়ে রাজশাহী আসেন। গত মাসে তাকে মহানগর দায়রা জজ হিসেবে পদায়ন করা হয়। রাজশাহী আসার পর নগরীর ডাবতলা এলাকায় বাসাভাড়া নিয়েছিলেন। সেখানে স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে তাওসিফকে নিয়ে থাকতেন তিনি।

গত বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটায় এই বাসায় যান লিমন। সেখানে তাওসিফকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি চিকিৎসাধীন তাসমিনা নাহারকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। এ ছাড়া ধস্তাধস্তিতে হামলাকারী নিজেও আহত হন। পরে তিনজনকেই ভবনের অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তাওসিফকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

শুক্রবার সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তাওসিফের লাশের ময়নাতদন্ত হয়। ময়নাতদন্ত করেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক কফিল উদ্দিন ও একই বিভাগের প্রভাষক শারমিন সোবহান কাবেরী। ময়নাতদন্ত শেষে মর্গের ভেতরে ঢুকে ছেলের লাশ একনজর দেখতে যান বাবা বিচারক আব্দুর রহমান। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জানান, তাওসিফের ডান ঊরু, ডান পা ও বা বাহুতে ধারালো ও চোখে অস্ত্রের আঘাত পাওয়া গেছে। এই তিনটি জায়গায় রক্তনালি আছে। সেগুলো কেটে গিয়েছিল। এ কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণও ছিল শরীরে।

তাঁরা মনে করছেন, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে তাওসিফের গলায় কালশিরা দাগ রয়েছে বলে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বলেছেন, নরম কাপড় দিয়ে শ্বাসরোধের কারণে এই দাগটি হতে পারে। তবে এটি মৃত্যুর প্রধান কারণ নয়। ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও শ্বাসরোধে হত্যার চেষ্টা একই সময়ে হয়েছে বলেও জানান ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। ময়নাতদন্তের পর কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের রাজশাহী সেন্টারের সদস্যরা রামেক হাসপাতালের নির্ধারিত কক্ষে লাশের গোসল করিয়ে দেন। পরে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্সেই লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। নিহত তাওসিফ রাজশাহী গভ. ল্যাবরেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।

এদিকে, সব আদালত, বিচারকের বাসস্থান ও যাতায়াতের সময় অবিলম্বে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী নিযুক্তসহ দুই দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দাবি বাস্তবায়নপূর্বক বিচারকদের কর্মের পরিবেশ ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে আগামীকাল রোববার থেকে সারা দেশের বিচারকরা একযোগে কলম বিরতি পালন করবেন বলে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। শুক্রবার বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিরুল ইসলাম ও মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম সই করা এক বিবৃতিতে এই দাবি জানানো হয়।

বিবৃতিতে আরেকটি দাবির বিষয়ে বলা হয়েছে, রাজশাহীতে হত্যার ঘটনায় বিচারকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অবহেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং গ্রেপ্তার আসামিকে আইন বহির্ভূতভাবে মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করে অপেশাদারত্ব প্রদর্শনের দায়ে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিচারকের ছেলে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গভীর শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বিবৃতিতে বলছে, রাজশাহীর মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আবদুর রহমানের ছেলে তাওসিফ রহমান সুমন নিহত এবং স্ত্রী তাসমিন নাহার গুরুতর আহত হন। হত্যার শিকার তাওসিফ রহমান সুমনের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছে এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে অ্যাসোসিয়েশন।

প্রকাশ্যে বিচারক পরিবারে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুরো বিচার বিভাগ আজ স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ। বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের প্রত্যেক আদালত/ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণ, এজলাস, বিচারকদের বাসভবন ও গাড়িতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের কাছে সুপ্রিম কোর্ট থেকে বারবার পত্র পাঠানোর পরও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও বিচার বিভাগের সদস্য ও তাদের পরিবার অরক্ষিত ও নিরাপত্তাহীন।

জেলা পর্যায়ের সব বিচারকের জন্য পর্যাপ্ত সরকারি আবাসন ও পরিবহন ব্যবস্থা নেই। চৌকি আদালতে কর্মরত বিচারকদের অবস্থা আরও শোচনীয়। ফলে বিচারকদের বাধ্য হয়ে অরক্ষিত বাসায় ভাড়া থাকতে হয়, রিকশা-ভ্যানে এমনকি পায়ে হেঁটেও যাতায়াত করতে হয়। এই দৃশ্য দেখার যেন কেউ নেই। বিচার বিভাগের প্রতি এই উদাসীনতা ও গাফিলতির বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে আমরা সোচ্চার থাকলেও রাষ্ট্র কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি; যার পরিণতিতে আজ বিচারক পরিবারে এ করুণ বিপর্যয় নেমে আসে।