পদ্মার চরে অপারেশন ফাস্ট লাইট: অস্ত্রসহ কাঁকন বাহিনীর ৬৭ জন গ্রেপ্তার
স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও কুষ্টিয়ার পদ্মার চরাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে আতঙ্কের রাজত্ব কায়েমকারী শীর্ষ সন্ত্রাসী ‘কাঁকন বাহিনী’র ৬৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
রোববার ভোররাত থেকে রাজশাহীর বাঘা, পাবনার আমিনপুর ও ঈশ্বরদী এবং কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের বিভিন্ন চরাঞ্চলে একযোগে পরিচালিত অভিযানে তাদের আটক করা হয়। এ অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন ফাস্ট লাইট’। এ সময় ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল পরিমাণ দেশি অস্ত্র, মাদকদ্রব্য, স্প্রিড বোট ও একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোহাম্মদ শাহজাহান অভিযানের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, কাঁকন বাহিনী দমনে পুলিশ, র্যাব ও এপিবিএন সদস্যদের নিয়ে যৌথ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এই অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন ফাস্ট লাইট’। এতে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ টিমের ১ হাজার ২০০ সদস্য অংশ নিচ্ছেন। ইঞ্জিনিয়ার হাসিনুজ্জামান কাঁকনের নেতৃত্বে গঠিত এই বাহিনীটি প্রায় এক দশক ধরে পদ্মার চরাঞ্চলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে।
স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী, কৃষক ও জেলেরা তাদের চাঁদাবাজি, খুন ও দখলবাজির কারণে দীর্ঘদিন ধরে অতিষ্ঠ। বাহিনীটির সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪০ জন। বাহিনীর প্রধান হাসিনুজ্জামান কাঁকন (৫০) কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের রায়চা গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৯৪ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি সম্পন্ন করে তিনি কয়েক বছর সৌদি আরবে ছিলেন। দেশে ফিরে রাজনৈতিক আশ্রয়ে বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন এই সন্ত্রাসী বাহিনী।
গত ২৭ অক্টোবর কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, রাজশাহীর বাঘা ও নাটোরের লালপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী মরিচা ইউনিয়নের চৌদ্দহাজার মৌজার নিচ খানপাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় তিনজন নিহত হন। পরবর্তীতে বাহিনী প্রধান হাসিনুজ্জামান কাঁকনসহ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে দৌলতপুর থানায় মামলা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, পদ্মার চরের কাঁকন বাহিনী ছাড়াও সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর মধ্যে রয়েছে মন্ডল বাহিনী, টুকু বাহিনী, সাঈদ বাহিনী, লালচাঁদ বাহিনী, রাখি বাহিনী, শরীফ কাইগি বাহিনী, রাজ্জাক বাহিনী, চল্লিশ বাহিনী, বাহান্ন বাহিনী, সুখচাঁদ ও নাহারুল বাহিনী। এসব বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ফলে খুন, চরের চাষি ও জেলেদের হত্যা, চরের জমি দখল, বাথানের রাখাল ও মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, মাদক ও অস্ত্র পাঁচার, বেআইনী অস্ত্র দখলে রাখা, নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন ও সর্বহারাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দান, পদ্মা চরের খড়ের মাঠ দখল এবং ডাকাতি। এতে অশান্ত থাকে চরাঞ্চল।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কাঁকন বাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত বেপরোয়া। তারা সামান্য কথাকাটাকাটিতেও অস্ত্র ব্যবহার করে। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর তাদের আস্ফালন কমবে বলে ধারণা করা হলেও, উল্টো দৌরাত্ম্য আরও বেড়েছে।
গত ১১ জুন ঈশ্বরদী নদীপথে অভিযান চালিয়ে কাঁকন বাহিনীর ৬ সদস্য গ্রেপ্তার, দুটি অস্ত্র উদ্ধার এবং ১৭ জুলাই সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে কাঁকনের ভায়রা ভাই ও আরও দুই সদস্য গ্রেপ্তারসহ তিনটি বিদেশি অস্ত্র ও ১২ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। তবে কাঁকন আত্মগোপনে রয়েছেন। স্থানীয়রা বলছেন, রাজনৈতিক আশ্রয় ও চরাঞ্চলের দুর্গম ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তাঁকে ধরা কঠিন। রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার শামীম হোসেন জানান, বিভিন্ন জেলার পুলিশ সমন্বয়ে কাজ করছে। পদ্মার চরের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধই আমাদের লক্ষ্য।
অভিযান শেষে রোববার বিকেলে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোহাম্মদ শাহজাহান তাঁর কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি জানান, অভিযানে মোট ৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৫৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে রাজশাহী রেঞ্জের রাজশাহী, পাবনা ও নাটোর জেলার চরাঞ্চলে।
অন্য নয়জন গ্রেপ্তার হয়েছে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার চরাঞ্চলে। এরা কাঁকন বাহিনীসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য। তাদের মধ্যে কয়েকজন সাজাপ্রাপ্ত আসামিও। ডিআইজি জানান, অভিযানে রাজশাহী, নাটোর ও পাবনা জেলা থেকে ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র, চারটি গুলি, দুটি গুলির খোসা, ২৪টি হাসুয়া, ছয়টি ডোসার, দুটি ছোরা, চারটি চাকু, তিনটি রামদা, দুটি চাইনিজ কুড়াল, একটি লোহার পাইপ, একটি টিউবওয়েল, পাঁচটি মোটরসাইকেল, ২০ বোতল ফেনসিডিল, ৮০০ গ্রাম গাঁজা ও ৫০ পিস ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছে।
আর কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের চর থেকে একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা, একটি স্পিড বোড, অস্ত্র রাখার একটি সিলিন্ডার, দুটি তাবু ও পাঁচটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে। ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, এই অভিযানই শেষ নয়। অভিযান শুরু হলো। এটি থেমে যাবে না। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখন থেকে নিয়মিত অভিযান চলবে। সন্ত্রাসী বাহিনীর কার্যক্রম পুরোপুরি নির্মূল সম্ভব না হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।
রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলায় কাঁকন বাহিনীর বিরুদ্ধে মোট ৮টি মামলা রয়েছে। স্থানীয়রা মনে করেন, রাজনৈতিক আশ্রয় ও চরাঞ্চলের দুর্গম ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কাঁকন এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। তবে চলমান ‘অপারেশন ফাস্ট লাইট’ অভিযান সফল হলে পদ্মার চরাঞ্চল আবারও স্বস্তি ও নিরাপত্তা ফিরে পেতে পারে।
সোনালী/জগদীশ রবিদাস











