ঢাকা | নভেম্বর ৯, ২০২৫ - ১২:২৪ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম

খরা-পানিসংকটে উত্তরাঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে

  • আপডেট: Saturday, November 8, 2025 - 9:00 pm

স্টাফ রিপোর্টার: উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। শুকনো মৌসুমে খাওয়ার পানি আর সেচের পানির জন্য হাহাকার লেগে থাকে, বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে। সরকারের তথ্য বলছে, এ অঞ্চলে বৃষ্টিও কমছে দিন দিন। আর সঙ্গে প্রচণ্ড গরম। চলতি বছরের জুনে সারাদেশেই ২০ শতাংশের মতো বৃষ্টি কম হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে তা আরও কম।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাড়তে থাকা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্যই এসব পরিবর্তন। বিজিয়ানদের কাছে এসব শব্দ একেবারে অপরিচিত। কিন্তু ‘কিছু একটা ঝামেলা চলছে’ বলে মনে করেন তিনি। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, কম বৃষ্টি আর বাড়তে থাকা গরম-এই তিন রকম চাপে এখন উত্তরের মানুষ। নওগাঁর সাপাহার, নিয়ামতপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, গোমস্তাপুর, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোরের বিভিন্ন এলাকায় এই চাপ দিন দিন আরও বাড়ছে।

এসব এলাকার কৃষিজীবী, শ্রমজীবী এবং নানা পেশার মানুষ পাল্টে যাওয়া প্রকৃতির নানা গল্প বলেছেন। তাঁরা শোনালেন বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের লড়াইয়ের কথা। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সামলাতে নানা প্রকল্প নেয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু দেশের শস্যভান্ডার এই উত্তর জনপদ এখনো অভিঘাত মোকাবিলায় প্রস্তুত নয় বলেই মনে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান। তিনি এ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে কয়েক দশক ধরে গবেষণা করছেন।

তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং এর অভিযোজনের প্রসঙ্গ এলে উপকূলীয় এলাকার কথাই আগে আসে। উত্তরাঞ্চলের বৈচিত্র্যময় পরিবেশ, এখানকার ভিন্নতা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ুর অভিযোজনের চেষ্টা খুব কমই চোখে পড়ে। উত্তর জনপদ মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়। খাবারের ওপর যদি আঘাত আসে, তবে তো পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, বিশেষত রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র এলাকা ইতিমধ্যেই খরা ও পানিসংকটের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে পরিচিত। ২০২৫ সালে গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘রিভিজিটিং দ্য ড্রাউট–ফুড ইনসিকিউরিটি নেক্সাস: আ সোশ্যাল-ইকোলজিক্যাল সিস্টেমস পারস্পেকটিভ’ শীর্ষক গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ যদি আরও বেড়ে যায় এবং পানি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা দেখা দেয়, তাহলে এ অঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তা অর্ধেকের বেশি কমে যেতে পারে।

নামছে ভূগর্ভস্থ পানি: তিলনা, সাপাহার সদর আর শিরন্টি- সাপাহারের এ তিনটি ইউনিয়ন চরম খরাপ্রবণ। তিলনা ইউনিয়নে আজ থেকে বছর দশেক আগেও মোটামুটি ৩০ ফুট মাটি খুঁড়ে পানি পাওয়া যেত। টিউবওয়েল বসানো ততটা কঠিন ছিল না। এখন ৪০ থেকে ৫০ ফুটে গিয়ে পাওয়া যায় পানির সন্ধান। অন্তত ২৬ বছর ধরে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত তিলনার চন্দুরার কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, এখন ৩০ ফুট নিচে গেলে পাওয়া যায় লাল বালু। সেখানে পানি নেই। মাটি মরে গেছে। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে পরিস্থিতি যা হয়, তা আর কবার নয়। এই কৃষক বলেন, পানির কষ্ট দিন দিন বাড়ছে এসব এলাকায়। আর তাতে গভীর নলকূপও অকেজো হয়ে পড়ে মাঝেমধ্যে। উপজেলায় মোট ৩৬০টি গভীর নলকূপ আছে। এর মধ্যে ফি বছর একাধিক নলকূপ নষ্ট হয়ে যায় বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাপলা খাতুন। তিনি বলেন, দেশের যেকোনো এলাকার চেয়ে এখানে কৃষির খরচ অনেক বেশি। প্রধান সমস্যা পানি। শুধু কৃষিজমিই নয়, অন্তত ৩০ শতাংশ বসতবাড়ির মানুষ চরম পানির কষ্টে থাকে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪৬৫টি অগভীর ভূগর্ভস্থ পানির পর্যবেক্ষণ কূপের ৪০ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণায় শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ও অবস্থান বিশ্লেষণে দেখা যায়, পানির ব্যাপক ব্যবহারের কারণে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে এক থেকে তিন মিটার পর্যন্ত পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ীর পানিস্তর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৯৮০-এর দশকে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নামলেও বর্ষায় পুনর্ভরণ হতো ১৬ থেকে ১৮ মিটার। কিন্তু ২০১০ সালের পর পুনর্ভরণ ১৬ মিটারের বেশি হচ্ছে না। নাচোল উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, উপজেলায় গভীর নলকূপ ছিল ২৫০টি। গত বছর বোরোর মৌসুমে ৫৫টিই বন্ধ ছিল। সেচ ছিল না, ফলে সেচনির্ভর চাষাবাদে প্রভাব পড়ছে।

উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা সালেহ আকরাম বলেন, উপজেলায় এবার অন্তত ৩৫ শতাংশ কম বোরো উৎপাদিত হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। কিন্তু সুরক্ষিত নেই রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলও। তিস্তা অববাহিকার ১২০ কিলোমিটার এলাকায় শুকনো মৌসুমে পানির স্তর নেমে যাওয়ার চিত্র দেখেছেন পানিবিশেষজ্ঞ আনোয়ার জাহিদ। গত শুকনো মৌসুমে এ কাজ শুরু করেছে তাঁর নেতৃত্বে একটি দল। আনোয়ার জাহিদ বলেন, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় এক জটিল সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। শুকনো মৌসুমে পানির স্তর নামছে আবার বর্ষা মৌসুমে প্রবল বর্ষণে নদীভাঙন বাড়ছে।

উত্তরাঞ্চলে কমছে বৃষ্টি: চলতি বছর জুন মাসে দেশে ২০ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। বাংলার বর্ষা ঋতুর প্রথম মাস আষাঢ় থাকে জুনের অর্ধেকটাজুড়ে। তারপরও বৃষ্টির এ অবস্থা। জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হলেও উত্তরের জনপদ রংপুর বিভাগে ৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টি কম হয়। রাজশাহীতে অবশ্য এবারের জুলাইয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তবে তা ধারাবাহিকভাবে হচ্ছে না; বরং দীর্ঘ মেয়াদে উত্তরে বৃষ্টি কমে যাচ্ছে। ২০১৮ সালে জার্নাল অব ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘স্প্যাশিও-টেমপোরাল ভেরিয়েশন অব প্রি-মনসুন রেইনফল অ্যান্ড রেইনি ডেইস ওভার বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় ১৯৪৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বৃষ্টির অবস্থা তুলে ধরা হয়।

সেখানে দেশের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি দেখা যায়, আর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত লক্ষ করা যায়। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহীতে শূন্য দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টি কম হয়েছে বছরওয়ারি। বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্ভরণ যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি ভূ-উপরিস্থিত যেসব জলাধার আছে, সেগুলোও যাচ্ছে কমে। যেমন সাপাহারের জবই বিল উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে শিরন্টি, গোয়ালা, আইহাই ও পাতাড়ী-এই চার ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। একসময় এ বিল ছিল কৃষি সেচের বড় উৎস। এখন এ বিলে, বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে যথেষ্ট পানি থাকে না বলে এর ওপর নির্ভরতা কমছে- এমনটাই বলছিলেন গোয়ালার কৃষক আবদুস সোবহান। তাঁর কথা, ‘বিলে পানি কমে আসায় শুকনার সময় নলকূপের ওপরই ভরসা।’

উত্তাপের প্রভাব কৃষিতেও: গত শতকের আশির দশকে কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের রমরমা সময় ছিল। সে সময় ফসলের শত্রু ছিল পোকা। এসব পোকা মারতে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে যায়। এর ফলও মেলে। শুধু কীটনাশকের ব্যবহার নয়, সেচযন্ত্রের সম্প্রসারণ ওই সময় বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু এসব পন্থা খুব বেশি টেকসই হয়নি। অচিরেই এসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আশির দশকে উত্তরাঞ্চলে মাজরা, পামরি ও বাদামি ঘাসফড়িংয়ের উৎপাত বেশি ছিল।

কিন্তু এখন ৮০টির বেশি পোকার মোকাবিলা করতে হচ্ছে উত্তরের কৃষকদের। এমন তথ্য জানান চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (হর্টিকালচার) এ কে এম মনজুরে মাওলা। তিনি বলেন, উত্তরের জনপদে বৃষ্টি কমে যাওয়ার কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে দিন দিন। এর প্রভাব পড়েছে কৃষিতেও। উষ্ণতা পোকার সংখ্যা বাড়িয়ে তুলেছে। অবশ্য এর সঙ্গে কৃষিতে অপ্রয়োজনীয় মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগেরও সম্পর্ক রয়েছে। দেশের মোট ধানের প্রায় ৬০ শতাংশ বোরো।

উত্তরের জনপদে, বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রধান ফসল এটি। মার্চ থেকেই দেশে গরম পড়তে থাকে। এ সময় গড় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলে বোরোতে পরাগায়ন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু উত্তরাঞ্চলে সে সময় তাপমাত্রা বেশির ভাগ সময়ই ৩৫ ডিগ্রির বেশি থাকে। এর অনিবার্য ফল হিসেবে ধানে চিটা ধরে। চিটা রোধে ধানের চারা জলমগ্ন রাখা অপরিহার্য। এ জন্য প্রয়োজন সেচ। কিন্তু উত্তপ্ত উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিম্নগামী। দিশেহারা কৃষক তখন বাধ্য হয়েই সেচের পরিমাণ কমিয়ে দেন।

এ অঞ্চলে খাদ্য পরিস্থিতি ঝুঁকিতে: সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সাময়িকীতে সম্প্রতি প্রকাশিত তিনজনের এক গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন বিভাগের শিক্ষক সারওয়ার হোসেন। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, বর্তমানে যেভাবে কৃষি চলছে, তা যদি অব্যাহত থাকে, তবে কিছু সময়ের জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়তে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার। একপর্যায়ে পানিসম্পদ ফুরিয়ে যেতে শুরু করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলবে। গবেষকেরা ভবিষ্যতের জন্য বিভিন্ন পরিস্থিতি পরীক্ষা করেছেন।

দেখা গেছে, যদি তাপমাত্রা ৩.৫ থেকে ৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায় এবং একই সময়ে উজানে পানি প্রত্যাহার বা বাঁধ নির্মাণের কারণে নদীর প্রবাহ কমে যায়, তাহলে উত্তরাঞ্চলে খাদ্যনিরাপত্তা প্রায় ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। আরও উদ্বেগজনক হলো কিছু ‘টিপিং পয়েন্ট’ বা সংকট মুহূর্ত চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন তাপমাত্রা ৩.৫ ডিগ্রির বেশি বেড়ে যাওয়া, উজানে ৩০-৫০ শতাংশ পানি প্রত্যাহার, কৃষি ভর্তুকি অর্ধেক বা পুরোপুরি কেটে দেয়া, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা।

সারওয়ার হোসেন বলেন, এই পরিস্থিতিগুলো একসঙ্গে ঘটলে খাদ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়বে এবং মানুষ চরম খাদ্যসংকটে পড়বে। গবেষকেরা বলছেন, খাদ্যনিরাপত্তাকে কেবল ধান-গমের উৎপাদন দিয়ে মাপা যাবে না। পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষি ভর্তুকি, জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা- সবকিছু মিলে একটি জটিল সম্পর্ক তৈরি করে। এই সম্পর্ককে না বুঝলে টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনই যদি সমন্বিত পরিকল্পনা নেয়া যায়, তবে বড় ধরনের সংকট এড়ানো সম্ভব। আর তা না হলে কয়েক দশকের মধ্যে উত্তরাঞ্চল একটি বড় মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। প্রথম আলো

সোনালী/জগদীশ রবিদাস